কিংশুক চট্টোপাধ্যায়
কাবলি
কাবলিকে আমি চিনতাম, যখন আকাশের দিকে তাকাতাম, মনে হত অপেক্ষার রঙ কত গাঢ়, যে কোনও দেওয়াল ঘড়ির পেণ্ডুলামের ভেতর আমি ওকে ফ্রক পড়ে হেঁটে যেতে দেখতাম। সবুজ ফিতেয় বাঁধা অল্প কোকড়ানো চুল, নাকের ওপর গুড়ো গুড়ো ঘাম, বুকে টেস্ট পেপার চেপে ধরে, কোলকুঁজো হেঁটে যেত জামরুল তলা দিয়ে। কাকিমা খুব ভাল বড়ি দিত ওদের ছাদে। কাবলি একবার পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পা ভাঙে। অ্যানুয়াল পরীক্ষা দিতে পারেনি সেবার, ও একটাই গান জানত, গানটা মনে নেই তবে। কাকিমা গানটা শেষ হওয়ার একটু পড়েই সন্ধ্যে দিতে উঠনে এসে দাঁড়াতো তুলসী তলায়। এহেন কাবলিকে একদিন আর খুঁজে পাওয়া গেল না। খোঁজাখুঁজি কম হয়নি। বাপ মরা মেয়ে, কিন্তু মাস ছয়েকের মধ্যে যখন কোনও খবরই আর পাওয়া গেল না, ধীরে ধীরে খোঁজার উৎসাহ কমতে শুরু করল লোকজনের। কিছুদিন পর ওর কথা ভুলে গেল পাড়াপ্রতিবেশী। হরিণেরা সেই দিন রাতে জল খেতে এসেছিল দল বেঁধে। মাছরাঙা পাখিটাও মরে পড়ে ছিল করমচা গাছটার নিচে। কাবলির পায়ে পায়ে ঘুরত যে কুকুরটা, সেটাও ছিল না চত্বরে। কেউ না দেখলেও, একটা কালো গাড়ি আর একটা কালো চশমা পড়া লোকের গল্প ছড়িয়েছিল বহু দূর। মোদ্দাকথা কাবলি হারিয়ে গিয়েছিল সেই দিন। নদীর এপাড় থেকে কেবলই কাবলি আর আমি মিলিয়ে যেতে চাইছিলাম ঐ ধূলোরং মায়া সিঁড়ি বেয়ে। এদিকে ভীষণ ভিড়, কোলাহল, পাতার পর পাতা প্রসব করছে গাছের পর গাছ, কাবলির জন্য কোনও যুদ্ধই আমি পারিনি সাজাতে। আজ দোল পূর্ণিমার রাত, কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে হাওয়ারা। আমি আর কাবলি মুখোমুখি। আমি জানলাম ওর গোপন নাকছাবির নাম, ওর পালক রাজপুত্রের গল্প।