নবীন বাংলা কবিতা
তৃতীয় কিস্তি
—বিভাস রায়চৌধুরী
নতুন কবিতা উঠে আসছে নিয়ত। কারণ কবিতা অফুরন্ত। এই সংখ্যায় আলিপুরদুয়ার থেকে অরুণাভ রাহারায়, কৃষ্ণনগর থেকে অভিরূপ মুখোপাধ্যায়, বনগাঁ থেকে অমর্ত্য বিশ্বাস—এই তিনজন তরুণ কবি পাশাপাশি জ্বালিয়ে রেখেছেন তাঁদের নিজস্ব ধুনি। যে যার সাধনায় জেগে থাকো, তরুণ কবি!
কবিতার জন্য যতদিন জেগে থাকতে পারবেন কোনও কবি, ততদিনই তাঁর হাতে থাকবে কবিতা। কবি হয়ে গিয়েছি ভাবলেই খেলা শেষ। মনে রেখো কবি ফুরোয়, কিন্তু কবিতা ফুরোয় না কখনও।
অরুণাভ রাহারায়
ইন্দ্রদুয়ার
উৎসর্গ: ইন্দ্রশংকর থাপা
সদরবাজার থেকে কিছুদূর উঠে
ভ্রামণিক দল ছোটে পাহাড়ের রুটে
পাথরের পথে আমি থেমে যাই বেশ
এখানে রয়েছে ঢেউ সমূহ-বিশেষ
প্রিয় এক মানুষের মুখ।
গান তার আলো মেখে ছড়িয়েছে ভোরে
বাঁশি থেকে ছড়িয়েছে বিষাদের সুর
ব্যাঞ্জো বেজেছে খুব দু’হাতের জোরে
এখানেই রাত জেগে গানে নেশাতুর…
পাহাড় দেখতে এসে, যার টানে, বনেছি বেকুব!
কবির মুখোমুখি
উৎসর্গ: কে. সচ্চিদানন্দন
ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে কবি দেখতে পেলেন:
লাঠি হাতে হেঁটে যাচ্ছেন গান্ধীজি…
বাপুর পিঠ কিছুটা ন্যুব্জ
চারপাশে ধোঁয়া উঠছে…
ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনা।
এমন সময় শুধু জেগে ওঠে কবিতারা
স্টকহোম থেকে উড়ে এসে কবিতাপাঠের আসরে
যোগ দেন টোমাস ট্রান্সট্রোমার।
মুহূর্তকে ঢেকে রাখে কেরালার গাছপালা…
দিল্লির দূতাবাসে অক্টাভিও পাজের সঙ্গে মোলাকাত
আড্ডার ওপর দিয়ে অতিকায় আলোর ছুটে যাওয়া…
সকালবেলায় গালে হাত দিয়ে
এইসব এলোমেলো ভাবেন কবি।
আমি তাঁর মুখোমুখি চুপচাপ বসে আছি…
বাঁশিওয়ালা
উৎসর্গ: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
এমন বাঁশির সুর টেনে রাখে শুধু
লামডিঙে ফিরে যাই, পাহাড়ের ধুধু
মানবজমিন থেকে সুদূরে কোথাও
একেবারে নিশ্চুপ! বলি না কথাও
শুধু দেখি বেজে যায় বাঁশির ভেতর
মুহূর্তে উঠেছে জেগে কালজানি চর
মালবাজারের থেকে যোধপুর পার্ক
ঘুরে এসে স্থির হয়ে পাক খাই, পাক
বাঁশিটির জাদুনল টেনেছে বিষাদ
মায়াবী মাধব তার, মধুরের স্বাদ
ডেকে আনে দূর থেকে বৃষ্টির হাওয়া
মাঝে মাঝে শ্বাস নিতে তাঁর কাছে যাওয়া…
অভিরূপ মুখোপাধ্যায়
বজ্র নাচ
ঘর। হাওয়া। আর আমি
জানলার পাশেই এক
মরা তাল গাছ
গাছ আর আমি আর
আমি আর গাছ
দু’জনেরই মুণ্ড খুলে
খেয়ে গেছে
অজস্র সম্পর্ক, বজ্র… নাচ…
গাছে বসছে হাসছে রোজ
কাটা স্কন্ধে হাসছে
এক পাখি দুই পাখি তিন পাখি চার পাখি পাঁচ…
কল্পান্ত
নিরাময়, ঘুম থেকে উঠে
মুখ ধোয়, জলখাবার খায়—
স্নান সেরে রোজ নিরাময়
আমাকে আরোগ্য দেবে বলে
আমার ভাগ্যের দিকে একবার তাকায়
আমি দেখি, বন্দিপ্রাণ
কী দুর্বল নিরাময়
লোহার শিকল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে…
সমুদ্রের বহু নীচে সেই কারাগার
আমাদের নিরাময় ছাড়া পাইনি আজও
সহস্র কল্পান্ত শুধু পার হয়ে যায়…
বৈধব্য
পুরুষও বিধবা হয়। প্রেমকে পুড়িয়ে এসে
রাত্রিবেলা স্নানে নেমে
দ্যাখে তারপর
আকাশ প্রস্তুত করছে তারই জন্য মেঘে মেঘে মেঘে
চাঁদরূপী থানের কাপড়
অমর্ত্য বিশ্বাস
থালা
রাতের বেলা যখন খেতে বসি
পাতের উপর নজর রাখে ভুলু
দুধ খায় না, মাছ ছোঁয় না
নজর রাখে খালি
হাঁড়ির সঙ্গে গভীর যোগাযোগে
যেভাবে মা হয়ে যেতেন থালা
আমি উঠতাম রেগে
খাওয়ার সময় এত কথা কেন?
মা বলতেন— নষ্ট হয় না যেন
জিভের উপর শৌখিনতার খিদে
আর আসে না!
নজর ওঠে ভুলুর চোখের দিকে
যে নজরে কোনও একদিন মা থাকত
গরম ভাতের পাশে
ছাতা
একটা ছাতাই বাবার বড্ড প্রিয়
যে ছাতাতে আমার শৈশবও
দিব্যি ছিল বর্ষাকালের মতো
হাঁটুরে জল, কাদায় ভরা
তার উপরে ছাতা
দৃষ্টি ফেলে ছায়ার মতন
ভরসা সারাবেলা
যেদিন হঠাৎ বর্ষা থামে
বয়স বাড়ে ছাতায়
অজস্র তার ছিদ্র এঁকে
খুব ফেলেছে মায়ায়
ছাড়ব ভেবেও ঠিক ভুলে যাই
রোদের মাঝে একা
বাবার হাতটা ঝাপসা দেখি
অধিক যত্নে রাখা
তিলোত্তমা
মেয়েটির শরীরে বারোটা তিল গোনা যেত
বুকের কাছে গোটা জীবনের লড়াই
পিঠের মেরুতে চন্দ্রহারা আকাশ
দূর থেকে মনে হয় পৃথিবী সেজেছে
মাতৃকলায় মেয়েটি যখন পূর্ণ রমণী
তখন কি আর তিলগুলি
সংযত হতে পারে?
নিজের জন্য নয়
অন্যের দাবিতে
কেউ তো আবার তিলোত্তমা হবে
‘নবীন বাংলা কবিতা’ প্রথম কিস্তি, ১৫০ সংখ্যা যারা এখনও পড়েননি :
সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম ১৬৮ সংখ্যা
বাংলা কবিতার ভুবন বিস্তৃত–এই সত্য উপলব্ধি করলে পাঠককে সন্ধানী হতে হবে। কবিতার ভুবন একক সংগীত নয়।পরিব্রাজকের মতো সন্ধান…