ধারাবাহিক রচনা

ভাঙা দিনের ঢেলা

মলয় গোস্বামী

চাকরি কোথায় ? চাকরি কোথায় ? প্রেমিকা লাথি মারে

 

 

১৯৭৮ সালে, হঠাৎ একদিন, একটি বিষয় নিয়ে ভাবতে ব’সে বুকের মধ্যে বজ্রপাত হলো। যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল আমার শিল্পজীবন। মনে হলো জীবন থেকে ধমনী-কাটা রক্তের ধারার মতন সমস্ত গানবাজনা-ছবি আঁকা-নাট্যাভিনয়-কবিতাগল্প-উপন্যাস-ম্যাজিক-দুরন্ত প্রেম সব চুঁইয়ে চুঁইয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমার মন খোলস-ছাড়া সাপের মতন বিবশ।

 

আমি হঠাৎই ভাবতে বসলাম, আমার ছোট ভাই মৃন্ময়, প্রাণাপেক্ষা প্রিয়, মা-র কথা অনুযায়ী আমি আর ও বেদের আঠালি, সেই ছোট ভাই মৃন্ময় একদিনের নোটিশে বনগাঁ ছেড়ে দিল্লি চলে গিয়েছিল ‘ফেনার ইণ্ডিয়া’ নামে একটি ইন্দো-ব্রিটিশ কোম্পানিতে চাকরি করতে! ‘ফেনার ইণ্ডিয়া’ মোটর গাড়ির ফ্যান-বেল্ট তৈরি করত। আমাদের বাড়ির পাশেই থাকেন জীবন দত্ত। তিনি রাজধানী এক্সপ্রেসের চাকুরিয়া। প্যান্ট্রিকারের। দিল্লি যান, আবার পরের ট্রেনেই চলে আসেন। সেই জীবন দা একদিন আমাদের বাড়ি এসে হঠাৎ মৃন্ময়কে বললেন, তুমি যাবে দিল্লিতে ? একটা চাকরি হতে পারে। একজনকে বলেছি। মৃন্ময় উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ জীবন দা আমি যাবো। জীবন দা বললেন, কাল সকালে আমি যাবো। তোমাকে নিয়ে যাবো। মৃন্ময় অবলীলায় সামান্য কিছু জামাপ্যান্ট নিয়ে, পরের দিন সকালেই জীবন দা-র সঙ্গে চলে গেল সেই সুদূর দিল্লি। মা-র চোখ ছলছল করেছিল। তার তো ছোট ছেলে। বাবাও বেশি কথা বলেনি। বাবা স্কুলের শিক্ষক। যে টাকা হাতে পেত সেই টাকায় সংসার চালানোর অর্থ ফুটো নৌকাতে সাগর পাড়ি। বাবা হয়তো ভেবেছিল—যাক। মৃন্ময়ের একটা হিল্লে হোক। জীবন দা মৃন্ময়কে রাজধানী এক্সপ্রেসের প্যান্ট্রিকারের, মানে ট্রেনের হেঁসেলের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দিল্লি পৌঁছে প্রথমে কয়েকদিন মৃন্ময় স্টেশনেই রাত কাটিয়েছে। যখন সে চাকরির উদ্দেশে রাজধানী এক্সপ্রেসে ওঠে, তখন তার পকেটে ছিল শত-খানেক টাকা।

 

পাড়ার লোকেরা, কেউ কেউ এসে বলতে লাগল—মৃন্ময় ঠিকই করেছে। এত বড় পরিবার শুধু একজনের আয়ে চলে নাকি! মৃন্ময় ছোট হলেও বাস্তববাদী। জানি অনেকের ঘৃণা আমার দিকে এগিয়েছে। কিন্তু সমস্ত শিল্পকে ছেড়ে আমি না-জানা এক সমুদ্রে ঝাঁপ দেব, তেমন বুকের পাটা, মৃন্ময়ের মতো, আমার ছিল না।

 

কিন্তু সেইদিন, বুকের মধ্যে বজ্রপাতের দিন, আমি মৃন্ময়ের বিষয় নিয়ে ভেবে, বাবার সাংঘাতিক খাটুনির কথা ভেবে, তিনটি বোনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেকে অমানুষ বলে মনে করেছিলাম। ভাবলাম সব ছেড়ে টাকা ইনকাম করবই। বোনদের বিয়ে দিতে হবে। বাবাকে সাহায্য করতে হবে। দুটো টিউশনি, আর একটা গানের টিউশনি করেছি ইতিমধ্যে। টাকা ঠিকমতন না-পেয়ে ছেড়েও দিয়েছি। কোলকাতার কয়েকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় মাঝে-মধ্যে লেখার ফলে, মানি অর্ডারে সামান্য কিছু আসে। এইরকম পেয়ে সমাজের মধ্যে বুক ফুলিয়ে ঘোরা যায় না। আবার এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রেমে পড়েছি। কয়েকটি প্রেম তো আমাকে দূরে যেতে দেবেই না। বেশ পাগল-পাগল অবস্থা।

 

জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। বাবা সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে, জামা-কাপড় পাল্টে, প্রায়ই দুটি হাঁটুর ওপর দিয়ে দু’হাত ঝুলিয়ে বিষণ্ণ মুখে বাজারের অগ্নিমূল্যের কথা মা-কে জানায়। মা হয়তো তখন রুটি বেলছে। আমি ঘর থেকে বেরনোর সময় এই দৃশ্য কখনও কখনও চুপ করে দেখে ফেলেছি। বাবা বলছে, স্কুল থেকে আর তো বেশি পাওয়া যাবে না। দোকানও বলে দিয়েছে… দিতে পারবে না ! হয়তো আমি তখন দেখছি, মা বাবার কথা শুনতে-শুনতে বেলন-চাকির দিকে না-তাকিয়ে রুটি বেলে চলেছে। আর কী আশ্চর্য! রুটি কিন্তু একটুও বেঁকে যাচ্ছে না! একেবারে গোল হচ্ছে। পৃথিবীর মতনই গোল। সত্যি কথা বলছি, আমি এরকমটি মনে করছি। তারপর নিজের মুখেই নিজে অদৃশ্য চড় মেরে বাইরে চলে গেলাম।

 

এই যে সংসার আর শিল্পের টানাপোড়েন আমার মন ও শরীর খারাপ করে দিতে থাকল। মৃন্ময়ের দিল্লি যাওয়ার সিদ্ধান্ত আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে থাকল—তুমি নৃশংস! তুমি মা বাবা ভাই বোনদের দায়িত্ব নিতে অক্ষম। ইচ্ছা-অক্ষম। অথচ মৃন্ময় তো গেল সংসারের জন্যেই। কিন্তু সে-ও এর পূর্বে প্রকাশ করেছে ‘হর্ষবর্ধন’ নামের একটি হাস্যরসের সাহিত্য পত্রিকা। খুবই সমাদৃতও হয়েছে পত্রিকার সংখ্যাগুলি। প্রমথনাথ বিশী, কুমারেশ ঘোষ, আশাপূর্ণা দেবী ভূয়সী প্রশংসা করে উৎসাহিত করেছেন তাকে। একাধিক চিঠি দিয়েছেন। রবীন্দ্রসদনের উল্টোদিকের ময়দানে অনুষ্ঠিত বইমেলায় মৃন্ময় একা ফেরি করে প্রচুর সংখ্যা বিক্রি করে করে ফিরে আসত আমাদের রক্তস্বাক্ষর পাবলিকেশনের স্টলে। রাত্রে আমি আর ও ফিরতাম সিঁথির মাসী-বাড়িতে। পত্রিকা বিক্রির টাকায় মাসীমার জন্যে কাপড় কিনছে। তাহলে মৃন্ময়ও তো শিল্পী। হাসির গল্পে তার শক্তি ঈর্ষনীয়। সে-ও তো চেয়েছিল পরিপূর্ণ লেখক-সম্পাদক হতে। তবু তো সে সংসারের হাল ধরার জন্যেই প্রায় সেকেণ্ডের সিদ্ধান্তে, চলে গেল দিল্লি! আমি কেন যেতে পারলাম না! প্রেমের সম্পর্কগুলির জন্যেই কি আমি জায়গা ছেড়ে নড়তে পারিনি! না যশের আকাঙ্ক্ষা ?

 

তখন, কেমন যেন মাথা নীচু করে ভাত খেতে বসতাম। পোস্তর দাম ছিল খুবই কম। সেই পোস্ত আর আলু দিয়ে বেশ তরল করে রান্না করত মা। একবার বলে ফেলেছিলাম, “মা, এইরকম ট্যালটেলে পোস্ত ভাল লাগে না। এরকম রান্না করো কেন?”

মা কিছুক্ষণ আমার দিকে শান্ত হয়ে তাকিয়ে বলেছিল—“এত বড় সংসার চালাতে এরকম ঝোল না হলে ভাত কটা গিলবে কী দিয়ে? তোর বাবার তো সেই বাঁধা গোরুর টাটা ঘাস।” তারপর থেকে খাওয়া নিয়ে মনে হয় কিছু বলিনি।

 

সিদ্ধান্ত নিলাম—চাকরি অবশ্যই দরকার। ৭৯ সালে বি এড-এ অ্যাডমিশন নিলাম। বি এড পাশ করলে শিক্ষকতার চাকরিটি পাওয়া যাবে।

একদিন রাগ করে দুটো প্রিয় বাঁশের বাঁশি বাড়ির পেছনের দেওয়ালে বাড়ি মেরে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলাম। তারা সরু সরু ফালি হয়ে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ল। বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব চাকরি পেয়ে ছিটকে পড়ল এদিক-ওদিক। পরে লক্ষ্য করেছি বহুবার আমার কবিতায় ভাঙা বাঁশি বারবার প্রবেশ করে আমাকে কাঁদিয়েছে।

 

চাকরি পাচ্ছি না। হাত খরচের জন্যে মাঝে মাঝে অন্যদের প্র্যাকটিক্যাল খাতা এঁকে দিচ্ছি। পয়সা নেওয়ার সময় মাথা নীচু করছি। বুঝতে পারছি লেখালেখির চাকরি ছাড়া কোনও চাকরিই আমি করার জন্যে তৈরী নই। তবু মাথার শিক্ষকতাকে রেখে ১৯৭৯ সালে গোবরডাঙ্গা বি এড কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। তখন আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। তার পূর্বেই লিখে ফেলেছি সত্যিকারের চিৎকৃত কবিতা:

দরবার কক্ষের ওপরে তাকাও

ঠুন্ ঠুন্ কাচের ঝাড়ে মোমের বদলে বোসে খিক্ খিক্ হাসছে সাপ

সিঁড়িতে কিছু টুপি, সারি সারি রক্তাক্ত সিরিঞ্জ ঢোঁক গিলছে অনন্ত পিপাসায়

লুকাতে লুকাতে তো দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে দিয়েছি একদম

নিজস্ব প্রাসাদে এভাবে নিজেকে

ঘিয়ের দোকানের সামনের লেজ গোটানো লাল কুকুরটার মতন মনে হয়

 

আবার তার ঠিক পরেই লিখে ফেলেছি এইরকম:

চওড়া ফণা ছোবল মারে নাভিমূলে রাত্রিবেলা

বিকারে জমে বিষ টুপ্ টাপ্ ল্যাবরেটরির ডিস্ট্রিলেশন

ভিতর তখন ছলাক্ ছলাক্ তীব্র আয়োডিনের খেলা

উদ্ধত স্তন হলুদ নীবির দেবযানী গো এ কোন পেষণ !

 

এই বি এড পড়াকালীন সময়ে একটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে আমার কবিতা ও গান শুনে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথিতযশা সাংবাদিক সুদেব রায়চৌধুরী আমাকে কাছে ডেকে অনেক কথা বললেন। বুঝতে পারলাম তিনি আমাকে বেশ পছন্দ করেছেন। আমার যে একটা চাকুরির দরকার তা-ও বুঝেছেন। মনে আছে, তিনি সাংবাদিক ড: পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে, তাঁর কার্ডের পেছনে, একটা অনুপত্রের মতন লিখে দিলেন। যাতে তিনি আমার একটি ব্যবস্থা করে দেন। যতদূর সম্ভব মনে পড়েছে পার্থ চট্টোপাধ্যায় অনুকূলচন্দ্র স্ট্রিটে ইত্যাদি প্রকাশনীর পরিবর্তন পত্রিকায় রয়েছেন। আমি সুদেব চৌধুরীর কার্ডটি সযত্নে আমার ডায়েরির মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হলেও চাকরির জন্যে কখনও বলিনি। বলতে পারিনি আর কী। চাকরির জন্যে কীরকম শরীর ও বাকভঙ্গিমা প্রয়োজন তা আমি জানতাম না। আমার এইরকম ভাবনা শুনে আমার দু’এক বছরের বড় বন্ধু স্বপন দাস, যে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন, বলল, না জানলে তো চলবে না। জানতে হবে। —আসলে সে তখনই পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ দপ্তরে চাকরি জোগাড় করে ফেলেছে।

(ক্রমশ)