গল্প

কামরাঙা

সায়ন্তন ঠাকুর

দুটো গাছে ঝেঁপে ফল এসেছে এবার। বর্ষার জল পেয়ে লকলক করে বেড়ে উঠেছে নতুন পাতা। ঘন সবুজ পাতার আড়ালে বোঁটায় ঝুলে আছে একসঙ্গে তিন চারটে করে কামরাঙা। আস্তে আস্তে হলুদ হয়ে আসছে তাদের গায়ের রঙ। কচি সবুজ রঙাও আছে কিছু।আরও কিছুদিন পর হলুদ হবে তারা। টক মিষ্টি স্বাদ হবে। রাতের বেলা পাকা কামরাঙার লোভে উড়ে আসে বাদুড়ের দল। পরদিন সকাল বেলায় আধখাওয়া ফলগুলো পড়ে থাকে গাছের তলায়। উঠোনে গাছদুটোর পাশেই বদন শেখেরঘর। মাটির দাওয়া। খোড়ো চালে মিষ্টি কুমড়ো লতা।ছোট ছোট সবুজ প্যাঁচানো আঁকশি দিয়ে চালের কঞ্চি আঁকড়ে ধরে বড় হয়ে উঠেছে। খড় পচে জায়গায় জায়গায় কঞ্চি বেরিয়ে এসেছে। সেইসব ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বৃষ্টির জল এসে ঢোকে ঘরে। থকথকে কাদা হয়ে যায় মাটির মেঝে। আজকাল বদন একটা হাঁড়ি কি কড়াই পেতে রাখে। তার ভেতরেই টপ টপ শব্দে জমতে থাকে জল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভরে যায়। ঘরে থাকলে দিনমানে সেই জল ফেলে আবার ফাঁকা হাঁড়ি পেতে দেয় বদন। আর বাড়ি না থাকলে উপচে জলে ভেসে যায় ঘর। কাঁথা তেলচিটে তোষক বালিশ ভিজে ফুলে ওঠে। ক’দিন পর সাদা সাদা নরম তুলোর মতো কীসব যেন গজিয়ে ওঠে সেখানে। ভ্যাপসা এক দমচাপা বাতাস ঘুরে বেড়ায় ঘরের ভেতর। ওই বাতাসে বদনের হাঁপের টান বাড়ে। কাশতে কাশতে গলা ছিঁড়ে খানিক রক্তও উঠে আসে। রাতের বেলা ওই কাশির শব্দ শুনে পাখা ঝাপটে পালায় উঠোনের কামরাঙা গাছের ডালে ঝুলে থাকা বাদুড়ের দল। ঘরের ওপর পাক খেয়ে উড়ে বেড়ায়। তারপর শব্দ থেমে গেলে আবার ফিরে আসে। আগে লাঠি নিয়ে তেড়ে যেত বদন। কামরাঙা খেতে খুব ভালবাসত তার আট বছরের ছেলে,তমিজ। মাঠের কাজ সেরে ফিরে বিকেলে গাছে উঠে বা আঁকশি দিয়ে পেড়ে দিত,বেছে বেছে হলুদ রঙা গুলোই পাড়ত বদন। দাওয়ায় বসে একটু লবণ মাখিয়ে চুষে চুষে খেত তমিজ। শ্রাবণ মাসের সেসব বিকেলে থেমে যেত বৃষ্টি। বাড়ির পিছনে জলাজমি,আতা গাছ,ফণিমনসা,বিছুটির ঝোঁপ পার হয়ে আদিগন্ত মাঠ। সে মাঠ সবুজ হয়ে আছে কচি ধানের রঙে। তারও পরে সিঁদুরে লাল আকাশ। গোটা দিনের শেষে ছাইরঙা মেঘ সরে গিয়ে পশ্চিম দিকে খুলে দিয়েছে যেন এক অলৌকিক রঙের বাক্স। বর্ষণক্ষান্ত বাতাস শিশুর মতো ছুটে বেড়াচ্ছে চারপাশে। দোলা লেগে উঠোনের আরেক পাশে ঝরঝর করে খসে পড়ছে পাকা বেগুনি জাম। দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে আনছে তমিজ। দুহাতের কচি মুঠি খুলে রিনরিনে গলায় বলে উঠছে,

–আব্বু,জাম খাবা ?

কোলে নিয়ে উঠোনে বাঁশের বেড়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াত বদন। আকাশ ধোয়া রঙে ভেসে যেত দুজন মানুষের শরীর। খেতে ধানের দিকে আঙুল তুলে তমিজ জিগ্যেস করত

–খেতি লিয়ে যাবা আব্বু একদিন ?

–খানিক বড় হ বাপ! লিয়ে যাব তুকে

–আকাশে ওগুলান কী অঙ আব্বু ?

কী বলবে ভেবে পায় না বদন। ওই রঙ কোথা থেকে আসে আবার কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে

–আল্লার অঙ রে। অক্তসন্দে। এমুন অঙ ধরলে ম্যাঘের গায়,আর বিষ্টি হবে না।

কী বোঝে আটবছরের বালক কে জানে। একমুখ হেসে বলে

–ইদ কবে আব্বু ? লতুন জামা কিনে দেবা না ? গোস্ত খাওয়াবা না ?

–দিব তো! গোস্ত লিয়ে আসব,তুর জামা…—হা হা করে হেসে ওঠে বদন।

–অসগোল্লা কিনে দিবা ?

অন্যমনস্ক হয়ে যায় বদন হঠাত। ছেলেটা রসগোল্লা খেতে ভারী ভালবাসে। এবার পরাণ চৌধুরীর জমিতে রত্না চাষ করছে বদন। বর্ষাও বেশ ভালো। লকলক করে বেড়ে উঠছে ধান। কালো মাথার মাজরা পোকার হাত থেকে বাঁচাতে কার্বোফুরানও ছিটিয়েছে। আরও মাস তিন পর কপাল ভালো থাকলে পয়সা পাবে বদন। ছেলেটার নতুন জামা,খড় ছাইতে হবে চালায়,বউএর একটা শাড়ি,মজিদপুরের মেলায় কাঠের চাকি বেলনা,দম দেওয়া খেলনা গাড়ি…কত ছবি একের পর এক ভেসে যেতে থাকে,সংসারী গেরস্ত মানুষের ছবি।

–আব্বু, দেবা কিনে অসগোল্লা ?

তমিজের ডাকে সম্বিত ফেরে বদনের।একটু হেসে বলে

–তুর কামরাঙা দাওয়ায় পড়ে আছে,খাবি লায় ?

রসগোল্লার কথা ভুলে টোকো কামরাঙার টানে বাপের কোল থেকে দাওয়ায় ছুটে যায় তমিজ। মাটি থেকে তুলে চুষতে থাকে। খেতের দিক থেকে ধেয়ে আসে বাতাস। আকাশ থেকে খসে পড়া রঙ মিশে যায় তার শরীরে। একটা পুরনো বিকেল গড়িয়ে যেতে থাকে সন্ধের দিকে। তার নীচে মাটির দাওয়ায় রচিত হয় কবেকার এক ছবি।

আজকাল বদন আর ছুটে যায় না রাতবিরেতে বাদুড় তাড়াতে। খাক ওরা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঠোনময় পড়ে থাকে বাদুড়ে খাওয়া কামরাঙা। বেগুনি হয়ে থাকে জামগাছের তলার মাটি। ডেঁয়ো পিঁপড়ের দলে সারি বেঁধে খেতে আসে জামের মিষ্টি রস। বেড়া ভেঙে পার্থেনিয়ামের ঝোঁপে ঢেকে গেছে সারা উঠোন।ছোটফিঙা গাঁয়ের একপ্রান্তে বদন শেখের এই বাড়ি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় আগাছা ঢাকা একটুকরো সবুজ ভূখণ্ড। কখনও সখনও গাঁয়ের ছেলেরা জাম কি দুটো কামরাঙা পাড়তে আসে। জিগ্যেস করে

–ও চাচা,দুটো জাম লিব ?

ঘরের ভেতর থেকে ভাঙা ঘরঘরে গলায় জবাব দেয় বদন

–যা যা লিয়ে যা,সব লিয়ে যা।

কাজকর্মও তেমন নাই বদনের। গত অঘ্রাণ মাসে ধানি জমি বাড়ি বেচে দিয়ে কলকাতায় ছেলের কাছে চলে গিয়েছে বুড়ো পরাণ চৌধুরী। সেই জমি যে কিনেছে তাকে চোখেও দেখেনি ছোটফিঙা গাঁয়ের লোক। যাওয়ার আগে বুড়ো চৌধুরী বদন কে বলে গেছিল

–বদন,তুর বাপ,তার বাপ আমার জমিরই সব চাষা ছেল। তুরা হলি আমাদের চাষা। তুর কুনও চিন্তা লায়, বলিছি তুর কুথা। তুই ই চাষ করবি,যেমন পয়সা পেতিস,পাবি।

–কিন্তু কত্তা, যদি লতুন মালিক চাষ না করি

–তু কি পাগল হছিস বদন ? ধানি জমি,তিন ফসলা জমি কিনে ফেলা রাখবে কুন বুকা ?!

কিছু বলে না বদন। চুপ করে বসে থাকে চৌধুরী বাড়ির পুরনো লাল মেঝের ওপর। সামনে একটা বড় হাতলওয়ালা ইজি চেয়ারে পরাণ চৌধুরী। সাদা ধপধপে ধুতি। গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। পাকা গমের মতো গায়ের রঙ। আশি বছর বয়সেও মাথায় একরাশ চুল। কলাইএর থালায় একরাশ মুড়ি,কাঁচা পেয়াঁজ,লঙ্কা আর দুটো গরম বেগুনী দিয়ে যায় চৌধুরীদের কাজের মেয়ে। পাশে একঘটি জল। জলের ছিটে মেরে মুড়ি খেতে থাকে বদন। কিছুক্ষণ পর পরাণ চৌধুরী নিজের মনেই যেন বলে ওঠে

–চিন্তা করিস লাই বদন। জমি হল মা লক্ষ্মী। তার দয়ায় তুর ভাতির অভাব হবি না,দেখিস।

–ভাতির চিন্তা করি লাই কত্তা, জমিতে ধান না বুনলি,শীতের মুখে সর্ষে না বুনলি,হাওর হয়ি পড়ে থাকবি যি আপুনার নক্কী। ওই মুর চিন্তা।

চুপ করে থাকে পরাণ চৌধুরী। একটা পুরনো ফ্যান শব্দ তুলে ঘুরে যেতে থাকে মাথার ওপর। কবেকার খোপ কাটা লাল মেঝের ওপর মুড়ি চিবোয় বদন শেখ। দেওয়ালে দশভূজা দুর্গার ছবি। এ বাড়িরই নাটমন্দির। ছোটফিঙার চৌধুরী বাড়ির দুশো বছরের পুরনো দুর্গাপুজো। বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সব। কলকাতার কোন এক লোক নাকি কিনেছে সব। ফসলি জমি,বাস্তুভিটে সব। পরাণ চৌধুরীর দাদুর বাবা ইঁট পুঁতেছিল এই ভিটের। জমিতে লাঙল দিতে ডেকেছিল বদনের বুড়ো দাদু তার বাপকে।

–আমারই কি যাতি মন চাইছি রে বদনা–ভাঙা ভাঙা শোনায় গলার স্বর।

খাওয়া থামিয়ে বদন বলে–যাছিন কেনে বাবু ? বুড়ো কত্তার ভিটে,জমি বেচে কেউ যায় !

মাথা নীচু করে বসে থাকে পরাণ চৌধুরী। পুরনো বাড়ির দালানে কোথা থেকে বয়ে যায় বাতাস। হাহাকারময় সে বাতাসে কাদের যেন সব দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে।

–যেতে হয় রে,বদন! ব্যাটা বড় হলি তার কথা বাপকে শুনতি হয়। সে এই ভিটে,ওই ফসলি জমি,দুর্গাদালান, চারপুরুষের পুজো কিছুই বুঝে না, আজকালকার পোলা, মুই-তু,তুই-মু এই আপনি কোপনির সংসার। তুর ব্যাটা তমিজ বড় হলি

কথা শেষ হয় না পরাণ চৌধুরীর। হঠাৎ যেন মনে পড়ে যায় সবকিছু। গেল চোত মাসে সেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা,শ্মশানে বুড়ো শিব মন্দিরের চাতালে গোরুর মাংসরেখে যায় কারা,ক’দিন ধরেই চাপা উত্তেজনা,তারপর একদিন অচেনা কতগুলো লোক রাতের অন্ধকারে ম্যাটাডোর ভর্তি করে ঢুকে পড়েছিল, খোলা তরবারি,জয় শ্রীরাম ধ্বনি…বদনের বউ, দুটো মাই কাটা দেহটা পড়ে ছিল আলের ধারে, বদন সন্ধে থেকে আটকে ছিল সেদিন রাস্তায়, পুলিশ কাউকে ঢুকতে দেয়নি গাঁয়ে,ধানের বীজ কিনতে বারাসাত গেছিল,পরাণ চৌধুরীর জমির ধানের বীজ,ফিরে পরদিন নালার ধারে তমিজের ছোট্ট দেহটা খুঁজে পায়, নাভির নীচ থেকে কাটা,পা দুটো আলাদা পড়ে ছিল নালার জলে, আলের ধারে বউ,রক্তমাখা দুটো শরীর।

চুপ করে যায় পরাণ চৌধুরী। স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে বদনের দিকে। গপগপ করে মুড়ি খেয়েচলেবদন। জলে ভেজা মুড়ি, গরম বেগুনী আর সবুজ কাঁচা লঙ্কা। দেওয়াল থেকে তাকিয়ে থাকেন পুরনো দেবী মূর্তি। খিদে বড় বালাই।

তেমন কোনও কাজ নেই এখন বদনের।সারাদিন নিজের ঘরেই থাকে। বর্ষার জঙ্গলে ঢেকে গেছে একফালি উঠোন। আগাছা,ফণী মনসার ঝোঁপ,বুনো কচুর বড় বড় গাছ ঘিরে ধরেছে বাড়িটা। বাঁশের বেড়া ভেঙে গজিয়ে উঠেছে ঘাসের দল। পাশের জলা জমিটা যেন গ্রাস করতে শুরু করেছে এই বাড়িটাকেও। অনেক ছেলেবেলায় বদন দেখেছে ওই জমিতে নঈম চাচার ঘর ছিল। কোথায় যেন চলে যায় চাচা বউ নিয়ে একদিন। ছেলেপিলে কেউ ছিল না। কেনই বা চলে গিয়েছিল, কী হয়েছিল সেসব জানে না বদন। কতই বা বয়েস ছিল তখন তার,বড়জোর সাত কি আট বছর হবে। আবছা এক স্মৃতি। শুধু মনে আছে, মঈন চাচার একটা কালো দুধের গোরু আর বাছুর ছিল, উঠোনে বাঁধা থাকত। গলায় একটা ঘণ্টাও ছিল বোধহয়। সেই কবেকার টুংটাং শব্দটা এখনও মনে আছে। গোরুটা বদনের বাবাকে দিয়ে গিয়েছিল চাচা। মাঠে চরাতে নিয়ে যেত বদন। উঠোনের একপাশে একটা চালার নীচে ঘর করে দিয়েছিল বাবা। রাতে সেখানেই থাকত।মাঝে মাঝেই গলা তুলে ডেকে উঠতো। ভারী মন আনচান করা সে ডাক। হাঁ করে বড় বড় দুটো অপলক চোখ মেলে তাকিয়ে থাকত তার পুরনো ভিটের দিকে। আজকাল বদন যেন ওই ডাকটা শুনতে পায়।

একেকদিন পরাণ চৌধুরীর জমির আলে গিয়ে বসে থাকে। আশপাশের সমস্ত জমি জুড়ে কচি ধানের শিষ বাতাসে মাথা দোলায়, শ্রাবণের মেঘ ভাঙা আকাশের নীচে একটুকরো সবুজ জলের মতো টলটল করে। শুধু চৌধুরীদের জমি বিনা আবাদে পড়ে থাকে। বুনো ঘাস ছেয়ে গেছে তার শরীরে। ঝিরঝির বৃষ্টি নামে। বাতাসের দোলায় এলোমেলো জলকণারা ছুটে বেড়ায় চারধারে। চুপ করে আলের ওপর বসে থাকে বদন। এমন বৃষ্টির দিনে কতবার একহাঁটু জল কাদা মেখে সরু সরু ধানের চারা পুঁতেছে সে।ওই আলের ওপর ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ি থেকে পান্তা ভাত,রসুন পেঁয়াজমাখা আলুসেদ্ধ অয়ালুমিনিয়ামের ডেকচি করে নিয়ে এসেছে বউ। কচি ধানের বীজতলা আর পান্তা ভাতের গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ভরা শ্রাবণের বাতাস তার সাক্ষী। আলের ওপর বসে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে জমিটার দিকে বদন। স্পষ্ট শুনতে পায় কী এক গোঙানির শব্দ। কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আপনমনে কেঁদে চলেছে। কেউ কোথাও নেই, দিকচক্রবাল রেখার ওপর অস্পষ্ট বৃষ্টির পর্দা,মাইলের পর মাইল সবুজ রঙা খেতের ওপর পাক খাচ্ছে ঘোলা অস্থিরমতি মেঘের দল। এলোমেলো বাতাস বইছে পূব দিক থেকে। দূরে পুকুরের জলে ঘাই মেরে আরও গভীরে পালিয়ে যাচ্ছে মাছের দল। চৌধুরীদের জমি পড়ে আছে বন্ধ্যা। ওই জমির হলুদ ধানের ছড়া কত কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে নাটমন্দিরের লক্ষ্মীর পট আলো করে রেখেছিল একদিন। সালংকারা দেবী আলের ওপর দিয়ে লাল আলতা মাখা পায়ে হেঁটে গেছেন কতবার। আরও ঘন হয় বৃষ্টি। কাক ভেজা বদনের শরীরের পাশ দিয়ে নিঃশব্দে বুকে হেঁটে আগাছা ভরা জমির দিকে নেমে যায় একটা চন্দ্রবোড়া সাপ। হাহাকারময় বাতাসের গতি তীব্র হয় আরও।

ঘরে চাল থাকলে দুপুরের দিকে একটু ভাত ফুটিয়ে নেয় বদন। উঠোনের বুনো কচু সেদ্ধ আর ভাত। ক’দিন পর চাল শেষ হলে ফুরনের কাজে বেরোয়। কোনও সম্পন্ন গেরস্ত বাড়ির আগাছা পরিস্কার করে দেয়। কারোর নারকোল গাছ কামিয়ে দেয়। গোয়াল ধুয়ে মুছে তকতকে করে দেয়। আবার কোনওদিন ভাগের পুকুরে জাল ফেলে। ক’টা টাকা পায়। চাল কেনে। একশো কি দুশো গ্রাম সর্ষের তেল। এক বাণ্ডিল লাল সুতোর বিড়ি। আবার ক’দিন চলে যায়।কাজের সময় মন পড়ে থাকে ওই মাঠের পানে। হালে বলদ জুতে মইএর ওপর দিয়ে চরকি কাটা। হালের ফলা একহাত ভিতরে ঢুকে বের করে আনে নরম ভুষভুষে মাটি। আহ! কী গন্ধ সেই মাটির। চোখ বন্ধ করলে সেই এখনও পায় সেই মাটির সুবাস। আগে যখন মাঠ থেকে ফিরে পুকুরে গোসল করে আছরের নামাজে বসত, পশ্চিমে অস্ত সূর্যের দিকে মুখ করে কৃপাময় আল্লাহর কথা স্মরণ করতো,তখন ওই নরম মাটির গন্ধ যেন উঠে আসতো চারপাশে। খিদের অন্ন জোগায় সে মানুষের। আল্লাহ-এর কাজ। নরম  এক মায়াবী আলোয় ভরে যেত বদন শেখের উঠোন। সে আলো গায়ে মেখে খেলা করে বেড়াতো আটবছরের তমিজ। চাল বসিয়ে আনাজ কুটতো বিবি। নিরাপদ গেরস্থালির ছায়ায় ঢাকা ছিল সে সব দিন। ভোজবাজির মতো কোন এক অদৃশ্য জাদুগরের ইশারার শূন্যে মিলিয়ে গেছে তারা। রেখে গেছে শুধু বদনকে।

আজ ডেকে পাঠিয়েছে ভটচায বাড়ি থেকে। ভটচাযদের ছোট মেয়ের বিয়ে। তিন হপ্তা বাকি আর। শ্রাবণের শেষ তারিখে সন্ধের লগ্নে বিয়ে। বাঁশের ভাড়া বাঁধা শুরু হয়ে গেছে। বাগান,বাড়ি সব পরিস্কার করতে ডাক পড়েছে বদনের। মেজকত্তা হারাণ ভটচায বাড়ির মুখে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে কাজকর্মের। বদনকে দেখতে পেয়ে মুখ তুলে ভারী গলায় বলে

–বদনা,ভালো করে পোস্কার কর দিনি। আগাছা সব তুলে ফেল। মেয়ের বিয়ে বলে কতা। কলকাতা থেকে বরযাত্রী আসবে। সব ঝকঝকে করে তোল দিনি!

–হ্যাঁ কত্তা।

–দুফুরে এখানেই খেয়ে লিস তুই,চাট্টি ভাত। সব শ্যাষ করি সেই বিকালে ঘর যাস খন।

–আপুনি যেমন কইবেন কত্তা।

ভালোই ঘাস জমেছে বাগানে। হেঁসো দিয়ে ঘাস নিড়োতে শুরু করে বদন। কাঠপিঁপড়ের বাসা ঘাসের ফাঁকে। ভালোই জ্বলুনি কামড়ে। দাগড়া দাগড়া লালচে দাগ উঠে যায় যেখানে হুল বসায়। মাঝখানে মেজকত্তা এসে ফের বলে

–বদন, নারকোল গাছ ক’খানাও কামিয়ে দিস বাবা।

–জ্বী কত্তা! –ঘাড় নাড়ে বদন।

কাজ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে যায়। আজ বৃষ্টি নেই। বেশ ক’দিন পর আকাশ আলো করে আবার রোদ্দুর উঠেছে। বর্ষা শেষের আকাশে কে যেন ঘন নীল রঙ গুলে দিয়েছে। উঁচু উঁচু নারকোল গাছের পাতায় পিছলে যাচ্ছে চকচকে রোদ্দুর। ভটচাযদের পুরনো বাড়ি দরদালান ঝলমল করছে সেই আলোয়। অনেকদিনের ভিটে। বাগানে সুপুরি,জামরুল,বাতাবি লেবুর গাছ। গন্ধরাজ লেবুরফুলে ভরে আছে ছোট ঝাঁকালো গাছটা। স্থলপদ্ম গাছের ডালে বসে আপনমনে ডেকে চলেছে পাখিটা—চোখ গেল! চোখ গেল! কেউ কোথাও নেই। যারা কাজ করছিল,তারাও বোধহয় খেতে গেছে। বদনকেও ডেকে গেছে দুবার। বিড়িটা শেষ করেই যাবে বদন। কী এক নিঝুম দুপুর। গাছ গাছালির ছায়ায় রোদ্দুরের তেজ তেমন বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে পাতায় পাতায় শরশর করে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। অনেক দূরে আকাশের গায়ে কালো ফুটকির মতো ভেসে যাচ্ছে কোনও একাকী চিল। লেবু ফুলের গন্ধে ম ম করছে সারা বাগান। একটা কাঠবেড়ালি দৌড়ে পার হয়ে মিলিয়ে গেল ঘাসের আড়ালে। ঝেঁকে ফল এসেছে জামরুল গাছে। গাছের তলায় পড়ে আছে কত জামরুল। হয়তো এ বাড়ির কেউ খায় না। জোলো সস্তা ফল। তমিজ খেতে খুব ভালবাসতো। জামরুল গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় বদন। নীচু হয়ে কুড়িয়ে নেয় দুটো ফল। বাতাসে পাক খেয়ে একটা কচি জামরুল পাতা নেমে আসে বদনের শরীরে।

–জামরুল খাবা ?!—মেয়েলি গলার স্বর শুনে চমকে ওঠে বদন। পিছন ফিরে তাকিয়ে দ্যাখে হারাণ ভটচাযের বড় মেয়ে রাণী দাঁড়িয়ে আছে। বিধবা মেয়ে। বিয়ের পরপরই স্বামী মরেছিল। সেই থেকে বাপের ভিটেয় থাকে। সাদা থান পরনে। একরাশ ঘন কালো চুল। ঢলঢলে শরীর। সোমত্থ বিধবা। পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়স হবে।

একটু হেসে বদন জিগ্যেস করে—মেলা ফল ইসিছে ইবার। তুমরা খাও না ?

–মরণদশা,জামরুল কেউ খায় নাকি ? জোলো ফল! পাকপাখালি খেয়ে যায়!–কৌতুকের হাসি খেলা করে রাণীর চোখে মুখে। টসটসে দুটো ঠোঁট। দাত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ফের জিগ্যেস করে

–তুমি একা একা কী করে বেড়াও মিঞা ?

–আল্লাহর দয়ায় একটা মিনিষ্যির প্যাট চলে যায় মা! চাষবাস তো আর হল না।

–চৌধুরীদের জমি ত্যামনি পড়ে আছে,লয় ?

–হ্যাঁ মা, কেউ লাই,বেবাক ঘাসে লষ্ট হয়ি যাচ্ছি জমিন।

–তুমাকেও তো দেখাশোনার কেউ লাই, অসুখ বিসুখ হলে কী করো তখুন ?

মলিন হাসি চকিতে ফুটে ওঠে বদনের মুখে। নীচু গলায় বলে

–চলি যায় মা! কুনওমতে চলি যায়।

–বিয়া করলি না কেন ফের ?

–বিয়া ? আর দরকার লাই মা বিয়ার। একা মনিষ্যি বেশ আছি। শুধু হারাণ কত্তার জমিনটা চাষ করতি পারলি…

কথা শেষ হয় না বদনের। বড় বড় দুটো চোখে কী এক বিদ্যুত ভাসিয়ে, তরল হিসহিসে গলায় রাণী জিগ্যেস করে

–আর শরীল ?

ভরা দুপুরে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে বদন। এলোচুলে হাত খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে ফের বলে রাণী

–আমাকে একদিন কামরাঙা খাওয়াবা বদন মিঞা ? মিষ্টি মিষ্টি টক টক…লবণ দিয়া মেখে খাব।

ভটচায বাড়ির ফুরনের কাজের টাকা শেষ হয়ে গেল ক’দিনেই। ঘরে চালও বাড়ন্ত। উপায়ন্তর না দেখে গাছের কামরাঙাগুলো একদিন পেড়ে বস্তা করে পাঠানপুরের বড় বাজারে এসে বসে বদন। ছোটফিঙা থেকে পুকুরের মাছ নিয়ে প্রতিদিন আসে কাশেম মোল্লা । নিজের ম্যাটাডোর করেই আসে। সেই ম্যাটাডোর চেপেই এসেছে বদন। ঘণ্টা খানেকের পথ। যদি বিক্রি করে কটা টাকা পাওয়া যায়। সেদিনও আকাশে মেঘ নেই। কড়া রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। বড় রাস্তার ধারেই বাজার। অটো,বাস,হলুদ ট্যাক্সি অবিরল বয়ে যাচ্ছে রাস্তায়। শহরের বাবুরা ব্যাগ হাতে বাজারে আসছে। থলি থেকে উঁকি দিচ্ছে সপ্তাহান্তের বাজার। সবুজ পুঁই লতা, লাল শাকের আঁটি। হলদে সবজে কামরাঙা নিয়ে চট পেতে রাস্তার ধারেই বসে আছে বদন। সাজোয়ান চেহারা। চওড়া কাঁধ। পরনে একটা চেক কাটা ময়লা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। একমুখ দাড়ি। রুখু একমাথা কোঁকড়া চুল। রোদ্দুরের তেজ থেকে ছায়া দিচ্ছে তাকে একটা মস্ত কদম গাছ। মাঝে মাঝেই কোথা থেকে উড়ে আসা বাতাসে ঝরে পড়ছে কদমফুলের রেণু। বদনের শরীরে লেগে যাচ্ছে সেই কুসুমরেণু। সাতটা কামরাঙা দশ টাকা। অনেকেই কিনছে। শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ভাতের পাতে কামরাঙার চাটনি খাবে হয়তো। রাস্তার ওপারে মা সারদা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কড়াইএ গরম রসগোল্লা চেপেছে। রাস্তা পার করে শ্রাবণের বাতাসে মিশে যাচ্ছে গরম রসগোল্লার গন্ধ। অনেকদিন আগে তমিজ খেতে চেয়েছিল তার বাপ বদনের কাছে।

——০——