ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লোহার

মণিশঙ্কর

 

অনুকথা

(ছয়)

ব্যস, ওই রাত্রিটুকু। পরের দিন থেকে আবার ঝরঝরে আকাশে সূর্যের সহাস্য দাপট। যদিও ওই বৃষ্টিতে দিন দুয়েক জুড়িয়েছিল ডাং-ডহরের বুক কিন্তু তারপর তো পেরিয়ে গেছে আরো সাতটাদিন। মাটি তাপ জড়ো করতে করতে আবার আগের অবস্থায়। সেই ঝলসানো রোদ। সেই ডাঙার বুক থেকে লকলকিয়ে উঠে যাচ্ছে চেরা জিভ। হাঁসফাস করছে প্রতিটি জীবের প্রাণ। পুকুর-ডোবাগুলোর মধ্যে যেটাতে সামান্য জল টিকে আছে তাতে গতর ডুবিয়ে রেখেছে ঘেয়ো কুকুরের দল। মহুয়া কিংবা বাবলাগাছের পাতলা ছায়ায় গা এলিয়ে জাবর কাটতে দেখা যাচ্ছে দু’একটা গোবাদি পশুকে।

উপায় নেই শুধু জনকের মতো এই বাংলার হাজার হাজার মানুষের। ভোটের আর মাত্র সাতদিন বাকি। এখন বাঁউড়ি-মকরেও এত চাঁয়ড় দেখা যায় না গ্রাম-বাংলার কুলিতে। যেন কোনও শোক নেই, তাপ নেই; পরবপাল-হাসি-কান্না নেই, পেটের দায় নেই, এমনকি প্রম-ভালোবাসারাও থমকে গেছে ওই একটিমাত্র হুল্লোড়ের হুযুগে। গ্রামের আকাশ-বাতাস মুখরিত করে সব সময় ধ্বনিত হচ্ছে, “ভোট ভোট ভোট দিন– ভোট দেবেন কোনখানে–”

অবশ্য সব সময় যে মিটিংমিছিল হচ্ছে তা নয়। তার বাইরেও থাকে বেশ কিছু কাজ। সব দলের কাছেই তার গুরুত্ব অনেক বেশি। তার জন্য গড়া হয় স্কোয়ার্ড। তবে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতো এমন দর্পের হুংকার কোনোবার শোনা যায়নি। না বিরোধী পক্ষের আর না সরকার পক্ষের।

আগামীকাল বাঁকুড়া জেলায় এই নির্বাচনের মতো রাজ্যস্তরের শেষ জমায়েত আছে জেলা সদরে। তার জন্য লোকভর্তি করার তাগিদ সব নেতাদের ঘাড়ে। এ তো শুধু জমায়েত নয়। বহর দেখিয়ে বিরোধীদের একটা বার্তা দেওয়াও বটে। শালগড়া গ্রাম পঞ্চায়েতও এ বিষয়ে পিছিয়ে নেই। প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি পাড়া থেকে ডাকা হয়েছে এক-একজন করে প্রতিনিধি। পঞ্চায়েত অফিসের গা লাগোয়া পার্টি অফিসে জমায়েত হয়েছে সব। মধুপুর গ্রামের লোহার পাড়ার প্রতিনিধি স্বরূপ এসেছে জনক। সঙ্গে তার ছায়াসঙ্গী সাগরাও। সেরাতে ঝগড়ার পর কেলিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি আর কোনো সংঘাত ঘটেনি। যদিও জনকের মানসিক উদ্যোগে এখন অনেকটাই ভাটা পড়েছে। তবু পার্টির কাজে গর্ববোধ করার এতদিনের অভ্যাসকে সে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। তাই অন্যান্য দিনের মতো আজকের মিটিং-এ তার উপস্থিতি।

বিকেল চারটে দেওয়া ছিল মিটিং-এর সময়। সেইমতো জমা হয়েছে ভিড়। কিন্তু ব্লকসভাপতি হরিসাধন দুবে এখনও এসে পৌঁছাননি। তাই মিটিং শুরু হতে পারেনি। জনকের পাশে বসে সাগরা অনেক্ষণ থেকেই উসখুস করছিল। কিন্তু জনক তাতে কোনো সাড়া দেয়নি। তাই সাগরা বলেই ফেলল, “অ্যা সাঙ্গাৎ, মিটিন কখন হবেক্ হ্যা? ই য্যা শালা বসে বসে পঁদে শিকড় গজাঁই গেলেক্!”

তবু জনক সাড়া দিল না। সাগরা তার দিকে হামদো মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। শেষমেশ তাকে একটা ঠেলা মারল। বলল, “অ্যা সাঙ্গাৎ, ঘুমাঁই গেলে নাকি হ্যা?”

“ক্যানে, কী হলেক্ কী? থির হঁইয়ে চুপ দিঁইয়ে বোস দেখি!”

“নাঃ, শুদুমুদু আর বইসে থাইকতে লাচ্চি। দাও দেখি, একটা বিড়ি দাও। দু’টা টান মাইরে লিই ততক্ষণকে।”

“অখন আর তুখে বিড়ি ফুকতে হবেক্ নাই। অখনি মিটিন আরম্ব হঁইয়ে যাবেক্।”

“ফুকব নাই বইলচ? থাইলে থাক। ফুকব নাই।”

আবার চুপ করে গেল সাগরা। মুখখানা ফুলিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপরই আবার থলথলে শরীরটাকে এদিক ওদিক হেলদোল করল। জনক পাশে বসে সাগরার প্রতিটি নড়চড়া বুঝল কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। সাগরাও আর থাকতে পারল না। আলতো করে ডাকল, “সাঙ্গাৎ! অ্যা সাঙ্গাৎ!”

“বল ক্যানে!”

“বলচি একটা কুথা বইলব তুমাকে?” এতক্ষণ যে কথাটা সাগরার পেটে ঘুলিয়ে বেড়াচ্ছিল সেটা বলার জন্য উন্মুখ হয়ে তাকাল জনকের দিকে। জনকও অস্ফুটে উচ্চারণ করল, “হুঁ।”

“বলচি, আজকে ত দুবেবাবুঅ আইসচে। ত সেই কুথাটা একবার পাইড়ে দেখবে নাকি উয়ার কাছে?”

“কন কুথাটা?”

“উঃ সাঙ্গাৎ, তুমি গাইদে ভুলকা বট। অই য্যা হ্যা, কেলিয়া শালার কুথাটা!”

“কেলিয়ার কন্ কুথাটা পাইড়ব?”

“অই য্যা হ্যা, রেতের বেলায়– গোণ্ডুগুল– সেই য হ্যা–” ফিসফিস করল সাগরা। জনকও একইভাবে ফিসফিসাল, “বের‍্যা শালা! উ কুথাটা আবার ইখ্যানে কী বইলব! আমি কি উ শালাকে ডরাই নাকি?”

“হঁ, তাও বটে। তবে–” আরও কিছু যোগ করতে যাচ্ছিল সাগরা কিন্তু তার আগেই জমা ভিড়টা চঞ্চল হয়ে উঠল। জনক দেখল সুভাষ মান হরিসাধন দুবেকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে ঢুকছে। হরিসাধন দুবে হাত নেড়ে ভিড়টাকে বসতে বললেন। তারপর এসে বসলেন লালটুকটুকে চেয়ারে। সুভাষ মান তার পাশের চেয়ারটি দখল করে হরিসাধনের কানে কানে কিছু ফিসফিস করল। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সকলের উদ্দেশ্যেই বলল, “আজকে তুদেরকে যার লাইগে ডাকা সেই কুথাতেই সুজাসুজি চলে আসচি। আজ আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন আমাদের বলক সভাপতি কমরেড হরিসাধন দুবে মহাশয়।”

কথা থামিয়ে হরিসাধনের দিকে তাকাল সুভাষ মান। মথা ঝুঁকিয়ে তাকে সম্ভাষণ জানাল। আবার বলতে শুরু করল, “তিনি তো বলবেনেই। তবে তার আগে আমি কতকগুলান কুথা তুদের সবাইকে বলে দিই। দ্যাখ, আগেও বলিচি। আবার বলচি, ভোটের আর মাত্তর সাতটা দিন বাকি। ইয়ার মধ্যেই আমাদেরকে যা করার কইত্তে হবেক্। মনে থাকে যেমন, একটা ভোটও আমাদের ছাপ ছাড়া আর কোনু দিগে যেমন না যায়। তার লাইগে যা করার তা তুদেরকে নিশ্চয় আর আলাদা কইরে শিখাঁই দিতে হবেক্ নাই! য্যা যাই বলুক্ ক্যানে, তুদের কোনু ভাবনা নাই। আমরা তুদের পাশে সোব সোময়েই ছিলম, আছিঅ।”

সুভাষ মান আবার কথা থামিয়ে ঘাড় ঘুরাল। তাতে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালেন হরিসাধন দুবে। সুভাষ মানও তার কথাতে ফিরে বলল, “তবে তার আগে কালকে বাঁকুড়ায় য্যা সভা আছে সেইটাকে সাকশ্যাস কইত্তেই হবেক্। সুবাই নিজের নিজের গাঁয়ের নিজের নিজের পাড়ার দায়িত্ব ল্যা। ঘরে যেমন একটা লোকও না থাকে। ছেল্যা-বুড়্যা– মেইয়্যা-মরদ আদি কইরে সুবায়েরেই কালকে যাওয়া চাই।”

“ই বাবা! ই কী কুথা বলচেন গ বাবু! সুবাই গেলে ঘরটাকে ক্যা দেখবেক্?” সুভাষ মানের কথা শেষ হওয়ার আগেই শালতোড়া গ্রামের ডোমপাড়ার দায়িত্বে থাকা মদনা ডোম সংশয় প্রকাশ করল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে খেঁকিয়ে উঠল রবি বাগদী। বলল, “উঁ– তুর ঘরে কী অমন রাজরাজড়ার ধনটা রইচে রে ব, আঁ?”

“ধন না থাক, তবু ত উটা ঘর বটে নাকি! তুঁই আর কী জানবি! অখন শালা গায়ে লতুন রঙ লাগাঁইচিস্। উ দিগে আমাদের গাঁয়ে বলে হরদম বাবুদের মিটিন চলচে।”

“হাঁ ভাল্ মদনা, মু সামলাঁই কুথা বলবি বইলে দিলম!”

“নাইলে কী কইরবি রে শালা? আমিঅ–”

“এই তুরা কী শুরু কল্লি কী?” মদনার হুংকার ভাষা পাওয়ার আগেই ধমকে উঠল সুভাষ মান। বলল, “এই রবিয়্যা, তুঁই চুপ দিঁইয়ে বোস দেখি। আমি যখন কুথা বলচি তখন তুর অত ফপরদালালি ক্যানে? বোস্ বলচি!”

“যা বাবা! আমি ত ভালর লাগেই–”

“স্যা আমিও জানি। তুঁই বোস্ দেখি আগে। হঁ, য্যা কুথা বলছিলম–” রবি বাগদী বেজার মুখে বসে পড়লে সুভাষ মান ফিরে এল তার আগের কথায়। বলল, “শুন্, নিজেদের মধ্যে যদি তুরা ইরকম একটুকুতেই গোন্ডুগুল লাইগে যাস্ থাইলে কী কইরে কী হবেক্ বল দেখি! সামনে আমাদের বিরাট লড়াই, ই কুথা ভুলে যাস্ নাই। অতদিন ধইরে য্যা লড়াই কইরে নিজেদের অধিকার তুরা আজ অর্জন করিচিস্ অখন অত সহজেই তাকে ভাঙে দিলে চলবেক্! বরং অখন আরও বেশি কইরে আমাদেরকে একত্রিত হতে হবেক্। ই হলেক্ যাঁইয়ে শমিক-কিষকের মিলিত ক্ষমতা। শোষিত মানুষের শোষনমুক্তির লড়াই। তবে হঁ, মদনা কিছু মন্দ বলে নাই। ঘরটাকে একদম ফাঁকা রাইখে যাওয়া ঠিক হবেক্ নাই। থাইলে এক কাজ কর, এক একটা ঘর থাকে অন্তত দু’জনা কইরে লোক যাতেই হবেক্। কী রে ব, ইবারে ঠিক আছে ত?”

এর উত্তরে কেউ কিছু বলল না। তাকেই সম্মতি ধরে নিল সুভাষ মান। বলল, “ব্যাশ, থাইলে তাই হোক। ইবারে আমাদের বলক সভাপতি কমরেড হরিসাধন দুবে মহাশয় তুদেরকে ক’টা কুথা বলবেন। আসুন দুবেবাবু।”

সুভাষ মান নিজের চেয়ারে বসে পড়লে হরিসাধন দুবে উঠে দাঁড়ালেন। গলাটা একটু পরিষ্কার করে জলদগম্ভীর গলায় বললেন, “কমরেড!”

সম্বোধনটা শুনেই জনকের সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে এল। সাগরাও নড়েচড়ে বসল। হরিসাধন দুবে সকলের মুখের দিকে চোখ বুলালেন। তারপর বললেন, “আমাদের এই জনসভাতে উপস্থিত থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। তাছাড়া রাজ্যস্তরের অন্যান্য নেতারা তো থাকবেনই। তোমরা সকলেই জানো, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সারা রাজ্যে কাজের জোয়ার আনার যে পরিকল্পনা নিয়েছেন তাতে বাধা সৃষ্টি করে রাজ্যটাকে পিছিয়ে দিতে চাইছে বিরোধীরা। আমি বেশি কথা বলবো না। আজ আমাকে আরও তিন জায়গায় মিটিং করতে হবে। তবু বলি, বিরোধীদের এর যোগ্য জবাব আমাদের দিতেই হবে। আর সেই জন্য কালকের জনসভাকে যেকোনও মূল্যে সফল করে তুলতেই হবে।”

দুবেবাবু তার ডানহাতের মুঠো উপরের দিকে তুললেন। তাতে কাজও হল। পিঠ বাঁকিয়ে বসে থাকা লোকগুলোর মেরুদণ্ড টানটান হয়ে এল। দুবেবাবু একটু থামলেন। সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে নিখুঁত পাটকরা সাদা রুমাল বের করলেন। সেটাকে নিজের কপালে বুলিয়ে আবার শুরু করলেন, “কমরেড! তবে একটা কথা, কালকের জনসভা হবে একটি ঐতিহাসিকসভা। সে জন্য আমরা যারা গান-বাজনা করতে পারি তারা তাদের সব বাদ্যযন্ত্র– ঢোল-ধামসা-মাদল, যার যা আছে তাই নিয়ে যাবো কালকের সভায়। যারা দলের সঙ্গে পুরোন দিন থেকেই আছো তারা জানো, আগে কীভাবে দলের সভা মুখরিত হয়ে উঠত শ্রমীক-কৃষকের শোষণমুক্তির গানে। কালকের দিনটা অন্তত আমাদের সেই আগের দিনগুলোকে স্মরণ করাতে হবে।”

দুবেবাবু আবার থামলেন। রুমালটা আলতো করে নিজের কপালের উপর দিয়ে চালিয়ে নিলেন। বললেন, “কমরেড! আমি দেখতে পাচ্ছি, সে সব দিন দেখেছে এমন মানুষ আমাদের মধ্যে আজ উপস্থিত রয়েছে।”

কথা থামিয়ে সরাসরি দৃষ্টি ফেললেন জনকের উপর। অমনি জনকের মেরুদণ্ড বরাবর একটা শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গেল। দুবেবাবু একটু মিষ্টি হেসে বললেন, “যদিও তোমরা অনেকেই সেসব দিনের সাক্ষি। তবু যার বাঁধানো গান তখন প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের রক্তে মুক্তির বান ছুটিয়ে দিত, রাতের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল শোষক শ্রেণির, তার ছেলে আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত। হ্যাঁ কমরেড! আমি জনক লোহারের কথাই বলছি। সেই মহান শহীদ কালিন্দী লোহারের সুযোগ্য ছেলে জনক লোহার। আসুন, আমরা সকলে তার জন্য একবার হাততালি দিই।”

অমনি চড়বড় শব্দে ভরে গেল ঘরটা। সুভাষ মানও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। যোগদিল সকলের সঙ্গে। তার মধ্যে একজন উঠে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিল, “কমরেট জনক নুয়ার জিন্দাবাদ।”

“জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।” সকলের মিলিত কণ্ঠে গমগম করে উঠল ঘরটা। লোকটি আবার বলল, “শহীদ কালিন্দী নুয়ার তোমাকে আমরা ভুলি নাই ভুলব নাই।”

“ভুলি নাই ভুলব নাই।”

“ইন-ক্যা-লা-প–”

“জি-ন্দা-বা-দ।”

মুহুর্মুহু শ্লোগানে কেঁপে উঠল বদ্ধ ঘরের বাতাস। সাগরার থলথলে মাংসে অযথাই হিল্লোল উঠল। আমড়া আঁটির মতো চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল বাইরে। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো হুঁকহুঁক করে কেঁদেও উঠল। কিন্তু তার এ কান্নাকে কেউই আমল দিল না। সবার দৃষ্টি এখন জনকের দিকে। জনকের মনেও যে শিহরণ না জাগল তা নয়। তবে তার শরীরী ভাষায় তা প্রকাশ পেতে দিল না। শুধু চোখ দু’টো জ্বালা করে এল তার। কিছুতেই বুঝতে পারল না, এতদিন পর হঠাৎ দুবেবাবু তার বাপের কথা তুললেন কেন! কেনই বা আজকের মিটিং-এর মূল আকর্ষণ করে তুললেন তাকে!

কিন্তু তার মনের খবর হরিসাধন কিছুই টের পেলেন না। তৃপ্তমুখে হাসলেন একচিলতে। তারপর দু’হাত তুলে সকলকে থামার ইঙ্গিত দিলেন। হাসিটুকু ধরে রেখে বললেন, “সুতরাং আমরা নিশ্চয় আশা করবো কমরেড জনক লোহার তার বাবার মতোই কালকের সভামঞ্চে কিছু না কিছু করবে। তা শুনে বিরোধীদের রাতের ঘুম উড়ে যাবে। যাইহোক, আমি আমার বক্তব্য আর বাড়াচ্ছি না। আমাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে। ইনক্লাব জিন্দাবাদ, শ্রমিক-কৃষকের মিলিত শক্তি জিন্দাবাদ।”

আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। সকলেই উঠে দাঁড়াল। পিছু নিল তার। সুভাষ মান জনককে চোখের ইঙ্গিতে বসতে বলল। তারপর হরিসাধনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। গাড়িতে বসতে বসতে হরিসাধন সুভাষ মানের দিকে তাকালেন। বললেন, “দেখুন আশাকরি আজকের ডোজটা কাজে লাগবে। তা সে গেল কোথায়?”

“উয়াকে ভিতরে বসতে বলে আলম। আমিও একটুকুন কথা বলে লিই।”

“ঠিক আছে। তাহলে তাই করুন। আর দেখুন কাল যত বেশি সংখ্যক লোক নিয়ে যাওয়া যায়। সকলকে বলে দিন ভিইকেল সকাল ন’টা-দশটা নাগাদ চলে আসবে।”

“ঠিক আছে।” সুভাষ মান ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানাল। সঙ্গে সঙ্গে জয়ধ্বনি উঠল হরিসাধন দুবের নামে। দুবেবাবু হাত নাড়তে নাড়তে এগিয়ে গেলেন। সুভাষ মান সকলের উদ্দেশ্যে বলল, “সুবাই শুনলি ত? সকাল ন’টার মধ্যেই গাড়ি লাইগে যাবেক্ ইখ্যানে। তার আগেই সোব নিজের নিজের গাঁ থাইকে মিছিল কইরে চলে আসবি। আর বাদ্যি-বাজনা যা–”

“কী যে বলেন বাবু! অখন আর বাদ্যি-বাজনা কুথাতে পাবেন?” হাসিমুখেই বলল একজন। সুভাষ মান তার কথাকে ততটা পাত্তা দিল না। একজন সাঁওতালকে বলল, “কী রে তুদের নাচের টীম রেডি আছে ত? নাকি তুরাও উ পাট চুকাঁই দিঁইচিস্?”

“না-না বাবু! আমাদের সোব রেডি।”

“ঠিক আছে। থাইলে কালকে সুবাই চলে আসবি। আমি আবার জনকার সঙে একটুকুন কুথা বলে দেখি যদি উ কিছু কইত্তে পারে!”

সুভাষ মান আর দাঁড়াল না। এগিয়ে গেল পার্টি অফিসের দরজার দিকে। রবি বাগদীও তার সঙ্গ নিল। অমনি তাকে খেঁকিয়ে উঠল সুভাষ মান, “তুঁই আবার কুথাকে যাচ্চিস্?”

“না– মানেকুথা–

“যা, অখন ঘরকে যা। কাল ঠিক সোময়ে চলে আসবি।”

রবি আর এগোবার সাহস পেল না। পা বাড়াল রাস্তার দিকে। সুভাষ মান স্বগতোক্তি করল, “সোব শালা একবার লায় পালে হয়। শুদুই কি আর লোকে বলে, বাঁদর আর ছুটুলোক লায় পালে মাথাতেই হাগতে খুঁজে! কী রে জনকা, অখনও তুঁই ভুঁয়েই বসে আছিস! আয় আয়, ই চিয়ারটাতে বোস। দিঁইয়ে শুনলি ত দুবেবাবু কী বলে গেলন?”

নিজে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সুভাষ মান। পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা গুঁজে নিল ঠোঁটে। লাইটার জ্বালিয়ে তার মুখে আগুন দিল। জনক মেঝে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু চেয়ারে বসল না। আজকের অতিখাতির তার ঠিক হজম হচ্ছে না। যদিও এতক্ষণ সাগরা তার পাশে গলগল করে যাচ্ছিল। সাঙ্গাতের এত বড়ো সম্মানে তার গায়ে ফুর্তি ধরছে না। কিন্তু জনক তারও কোনো জবাব দেয়নি। এখন আবার সুভাষ মানের খাতির দেখে তার বুকে জ্বালা ভাবটা ফিরে এল। মুখ বাঁকিয়ে বলে ফেলল, “আমি আর পাটির ক্যা বটি বাবু! অখন ত আর লোকের অভাব নাই!”

“অ, থাইলে আমার পারা কুথাগুলা তুর কানকেও গেছে?” একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বলল সুভাষ মান। আর অবাক হল জনক। সুভাষ মানের ইঙ্গিতটা কোন্ দিকে যাচ্ছে সেটা ধরতে পারল না। জিজ্ঞাসু মুখে তাকাল তার দিকে। সুভাষ মান একটু মিচকি হাসল। বলল, “তুঁই কী ভাইবেছিলি, আমি কিছুই বুঝতে লাচ্চি? এই ক’দিনে তুর মতিগতির কোনু খবর আমরা পাই নাই? শুন্ জনকা, অতদিন ধরে পাটি কচ্চিস্ আর ইটুকু বুঝলি নাই, ই সোব শালা রটাচ্চে উ গয়লারা? শালারা য্যা অখন দিদিকে লিঁইয়ে গাদে লাচন-কুঁদন লাগাঁইচে রে ব। স্যা খবর কি রাখিস্?”

তবু জনক কিছু বলল না। একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল চুপচাপ। সুভাষ মান সিগারেটে আরেকটা টান দিল। ভনিতা ছেড়ে সরাসরি বলল, “শুন্ থাইলে তুখে খুলেই বলি। পুঞ্চায়েতের কাজটা তুরেই হবেক্। তবে অখনঅ ভ্যাকেন্সি আসে নাই। বুঝলি নাই? আলে আমি নিজে তুখে জানাব। খবর য্যা একটা রটিচে স্যাটা আমিও শুনিচি। তবে তুঁই য্যা স্যাটাতে বিশ্বাস করে আমাদেরকেই ভুল বুজবি সেইটা ভাবি নাই। বুঝলি কিছু?”

এবার জনকের মুখের রেখারা কিছুটা নরম হয়ে এল। গলার রুক্ষতা মুছে বলল, “বাবু, আমি পেথমে বিশ্বেস করি নাই। তাবাদে যখন সুবাই বলতে লাগালেক্, তখন–”

“সুবাই যখন বলতে লাগালেক্ তখন তুঁই আমাকে একবার সোজাসুজি শিধালি নাই ক্যানে?”

“আজ্ঞ্যা স্যা দিনকে ত– তাবাদে আমি ভাইবেছিলম–”

“কী ভাইবেছিলি? আমি তুর প্যাটে লাত মাচ্চি? অরে, আমি কি আর না জানি, তুঁই পাটির লাইগে কী করিস্ না করিস্! যাকগুয়া, যা হঁইচে হঁইচে। উসোব আর মনে রাখিস্ নাই। তবে একটা ব্যাপার লিঁইয়ে আমার খুবেই ভাবনা হচ্ছে বুঝলি?”

সুভাষ মান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল জনকের চোখের দিকে। সহানুভূতি প্রকাশ করে বলল, “স্যা দিনকে বল্লি নাই, তুঁই মুখুজ্যাদের গতান্যা মুনিসে জবাবা দিঁইয়ে দিঁইচিস্, সেই কুথাটাই বলচি। অখন সমবছরটা তুরা খাবিটা কী?”

“হঁ, সেই লাগেই ত রেতে ঘুম হচ্চে নাই বাবু।”

“শুন্, তুদের পাড়ার কেলিয়া পুঞ্চায়েতে একটা অভিযোগ করিচে তুর নামে। আমি বলি কী, তুঁই বরং নিমাই মড়লের আইদরি চাষটাই কর।”

“হঁ, মড়লের সঙে স্যা রকমেই কুথা হঁইচে আমার। তবে–”

“কী? কেলিয়া? ধুর, উ শালা কী কইরবেক্ রে! দাঁড়া একবার ভোটটা পেরাঁই যাতে দ্যা, তাবাদে শালাকে দেখচি। তুঁই কোনু ভাবনা করিস্ নাই ত। আমরা ত তুর সঙেই রইচি। কী বুঝলি?”

“ঠিক আছে বাবু! আপনি যখন বইলচেন, তখন তাই করি।”

“হঁ, তাই কর। আর কালকে দ্যাখ্ যদি তুর বাপের গায়েন সভামঞ্চে গাইতে পারিস্ ত।”

“আচ্ছা বাবু।” ঘাড় হেলাল জনক। সুভাষ মান সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বাকিটুকু ছুঁড়ে ফেলল জানালা দিয়ে। তারপর লম্বা করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, “ব্যাশ, থাইলে আজকে আয়। কালকে সকাল সকাল চলে আসবি। আর শুন্, তুদের গাঁয়ের শান্তি মুখুজ্জ্যাও ত গাদে বাড়াবাড়ি লাগাঁইচে রে। শালাকে এতবার উদম ক্যালানি খাওয়া করালম তাও ধ্যাজ নাই রে ব! এক কাজ কর দেখি, আজ রেতের বেলায় একটা সাদা থান উয়ার দুয়ারে ফেলে দিঁইয়ে আয়। তাও যদি না শুদরায় থাইলে– বুঝলি নাই– মানেকুথা–”

কথা শেষ না করে চোখ নাচাল সুভাষ মান। কিছু একটা ইঙ্গিত করল। জনক ঘাড় হেলিয়ে পা বাড়াল বাইরের দিকে। বলল, “আচ্ছা বাবু! আয় সাগরা।”

কিন্তু সাগরার ঘোর তখনও কাটেনি। হাঁ করে তাকিয়ে থাকল সুভাষ মানের দিকে। সুভাষ মানের ভ্রূ কুঁচকে এল। জানতে চায়ল, “কী রে, কিছু বলবি নাকি?”

“আঁ! কই না ত!”

হঠাৎ যেন সাগরা আকাশ থেকে পড়ল। হামদো মুখের হাঁ-টা চট করে বন্ধ করল। তাকাল দরজার দিকে। দেখল, জনক প্রায় বাইরে বেরিয়েই পড়েছে। অমনি বলল, “দাঁড়াও হ্যা সাঙ্গাৎ! আমিঅ যেছি।”

লদপদে শরীরটাকে নিয়ে দৌড়ে গেল দরজার দিকে। অমনি কোথা থেকে এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকল জানালা দিয়ে। লাগল সুভাষ মানের মুখে। আরামের আবেশে তার চোখজোড়া বন্ধ হয়ে এল। আর জনকের মনে ভেসে উঠল তার বাপ্ কালিন্দী লোহারের লৌহমুখ।

 

অনুকথা

(সাত)

কুল্লাডির পুকুরটাতে জল প্রায় নেই বললেই চলে। পাঁক উঁকি দিচ্ছে জায়গায় জায়গায়। তাতেই গা ডুবিয়ে পড়ে রয়েছে একটা কুকুর। জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে আর জুলজুলে চোখে তাকিয়ে আছে পাড়ের দিকে। সেখানেই একটা অর্জুনগাছের গোড়ায় চুপচাপ বসে আছে জনক। চুপচাপ ঠিক নয়। ভাবছে। ভাবছে লোহারদের কথা। তার বাপ কালিন্দীর কথা। তার মা ভাবির কথা। কিন্তু কী! তা কিছুতেই মাথায় খেলছে না। শুধু মুখগুলো একের পর এক জলছবির মতো ঘেটে যাচ্ছে চোখের সামনে। সেই ঘেটে যাওয়া আবছায়া নিয়েই তাকাল সামনের দিকে। ভাবনার স্রোতে টান পড়ল এখানেই। ধৈর্যে ধরল ফাটল। বিড়বিড় করল, “শালা, আসার কনু নামগন্ধ নাই যে রে ব! মল্লেক্ নাকি!”

উঠে দাঁড়াল জনক। হাত দিয়ে রোদ আড় করে তাকাল শালগড়া থেকে বেরিয়ে আসা পথটার দিকে। এই জৈষ্ঠ্য শেষেও আগুনশিখা লকলক করছে চেরা জিভের মতো। কোনোদিকে বিন্দুমাত্র সবুজের ছোঁয়া নেই। কিছুটা দূরে গয়লাদের শ্মশান। তার নীরবতা জমাট করে রেখেছে যে ঝোপঝাড়েরা তারাও নিথর। খাঁ-খাঁ করছে উঁচুনিচু জমিজিরেতের শুকন বুক। খাঁ-খাঁ করছে জনকের বুকের ভিতরটাও। ফাটল দেখা দিতে চাইছে তার জেদে। বদলে কান্নার দলাটা গুমরে উঠছে ভিতরে। কিন্তু সে কাঁদবে না। কিছুতেই না। আবার জেদটা ঘন হয় এল জনকের মাথায়। গলা দিয়ে আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এল, “শালার জাতের ভসেরভূত খেদে ছাড়ব আজকে। তাবাদে যা হয় হবেক্! কালিন্দ্যা নুয়ারের বীচ বটি আমি। অত সহজে হার মানব নাই। ইয়ার শ্যাষ দেখে তবে দম লুব। উঃ, অত করেও শালাদের কারুর মন পালম নাই রে ব!”

কিন্তু পুকুর পাড়ের কোনো দিক থেকেই তার আর্তনাদের কোনও জবাব এল না। কে দেবে জবাব! তার এই অবস্থায় কার কী এসে যায়! পঞ্চায়েতের ভোট শেষ। বেশিরভাগই আছে বামেদের দখলে। চারিদিকের এত যে চেঁচামেচি, মহানগরের পথে পথে নাগরিক সমাজের মিছিল-মিটিং, টিভি পর্দায় গলা ফাটাচ্ছে নেতা-বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু কই, তার ফল কী হয়েছে! ভোটে তার প্রভাব কোথায়! যদিও বিরোধীরা বারবার অভিযোগ তুলছে বুথ দখলের– নির্বাচনী সন্ত্রাসের। কিন্তু তাতেই বা কী! ভোটের ফলাফল ‘আমাদের’ অহংকারের পালে লাগিয়েছে হাওয়া। তার প্রকাশ ঘটছে ছোটোবড়ো নেতাদের শরীরী ভাষায়। শুধু জঙ্গলমহলে একটা বড়োরকমের ধাক্কা খেয়েছে বামেরা। কিন্তু তাতেই বা কী! গ্রীষ্মশেষের এই উত্তাপের মতো তপ্ত হয়ে রয়েছে বাম-ডান সবারই মন।

উত্তাপে দগ্ধ হচ্ছে জনকের মনও। যদিও সে অতশত বোঝে না। তাদের সমাজের বাকিদের মতোই ভাতকাপড়ের জীবন-যাপন তার। তাতেই আবদ্ধ চাওয়া-পাওয়ার হিসেব। সেই হিসেব মেটাতেই এই ভরদুপুরে অপেক্ষা করছে জনমানবহীন এ তপ্ত প্রান্তরে। কিন্তু কই! যার জন্য অপেক্ষা তার টিকিটির তো দেখা নেই!

জনক আবার বসতে গেল পাছা পেতে। ঠিক এই সময় কানে বাজল ভুটভুট শব্দ। অমনি তার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেল ঠাণ্ডা শিহরণ। টান ধরল শরীরের চামড়ায়। ওই টান নিয়েই সোজা হল সে। দেখল, একটা মোটরবাইক মেটে পথটা বেয়ে এগিয়ে আসছে। মাথায় পাগবাঁধা গামছাটা খুলল জনক। বাঁধল কোমরে। নেমে এল পুকুর পাড় থেকে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল পথটার মাঝ বরাবর। আবার তাকাল মোটরবাইকটার দিকে। দু’জন মানুষ বসে আছে। সুভাষ মান চালাচ্ছে। কিন্তু পিছনের জন কে! চোখকুঁচকে চেনার চেষ্টা করল জনক। ততক্ষণে বাইকটা অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। এবার জনক চিনতে পারল। পাশের গাঁয়ের আশুতোষ সিংহ। রাজপুত রক্তের তেজ দেখায় যাকেতাকে। কখনও কখনও সুভাষ মানের দেহরক্ষীর কাজে লাগে। জনকের কষের একদিক বেঁকে এল। বিড়বিড় করল আপন মনে, “অ, আজকাল থাইলে আর ইকা কুথাও বেরাতে লাইচ্চে! ডর! ত, অতই যদি ডর, থাইলে লোকের পঁদে লাগতে যাওয়ার–”

কিন্তু বিড়বিড়ানিটা শেষ হওয়ার সুযোগ পেল না। তার আগে বাইকটা এসে দাঁড়াল ঠিক তার সামনেটিতে। যেন ভূত দেখেছে এমন ভাবেই চমকে উঠল সুভাষ মান। মেজাজ হারিয়ে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে। হাঁক পাড়ল, “কী রে ব, পথটার মাঝখ্যানটাতে দাঁড়াঁইচিস্ কী লাইচতে?”

“আপনার সঙে ক’টা কুথা রইচে আজ্ঞ্যা।”

“তার লাইগে ই চাঁদিফাটা রোদে পথ আঁটকাঁইয়ে দাঁড়াবি! ক্যানে পাটি অপিসকে যাইতে লারিচিস্?”

“পাটি অপিসে যাঁইয়ে ইসোব কুথা বইল্লে কি আপনার মান থাইকথক্ বাবু?” জনকের কষ দু’টো আবার বেঁকে এল একটুখানি। গলার বিদ্রূপকে ঠেকাতে পারল না। সুভাষ মান তার উত্তরে কিছু বলার আগেই বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল আশু। জনক আড়চোখে দেখল তাকে। কিন্তু গেরাহ্য করল না। সুভাষ মানকেই বলল, “না বাবু, অ্যানেক পাটি হলেক্, আর লয়। ইবারে যা কুথা স্যা শুদু তুমার সঙে আমার। একদম মুখ্যামুখি।”

“বটে রে জনক্যা!” সুভাষ মানের পরিবর্তে এগিয়ে এল আশু। বলল, “তুর য্যা দমে বাড় বাড়িচে দেখচি রে ব! কার সঙে ক্যামন কইরে কুথা বইলতে হয় স্যাটাও ভুলে মারিচিস্?”

আশুর একথাকেও পাত্তা দিল না জনক। সুভাষ মানের চোখে চোখ ফেলে বলল, “যার সঙে যেমন কইরে কুথা বলার দরকার বটে তেমনটি কইরেই বলচি আমি। ত তুঁই আবার মাঝখ্যানে ফপরদালালি মাইত্তে আসচিস্ ক্যানে?”

“এই শালা, মু সামলাঁইয়ে কুথা বলবি বলে দিলম। জানিস্ কার সঙে তুঁই কুথা বলচিস্?”

“হঁ-হঁ, জানি। তুঁইঅ ভুলে যাস্ নাই তুঁই কার সঙে কুথা বলচিস্! তুর উ ফাঁকা গাঙানিতে জনকা নুয়ার ডরায় নাই বুজলি?”

“বটে রে শালা! যত বড় মু লয় ততবড় কুথা!” আশু ডান হাতটা তুলল সজোরে। কিন্তু সেটা নেমে আসার আগেই সুভাষ মান মৃদু ধমকের সঙ্গে বলল, “এই আশু! তুঁই থাম।”

“আমাকে থাইমতে বলচেন আপনি! আমাকে! আর উ শালা য্যা–” অবাক হল আশু। এমনটা তো আগে কখনও ঘটেনি! যখনই সুভাষ মানের দিকে কেউ আঙ্গুল তুলেছে তখনই সে আগ বাড়িয়ে সে-আঙ্গুল ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু সুভাষ মান তো কখনও তাকে বাধা দেয়নি! তাহলে!

এই তাহলেতে এসে থমকে গেল আশুর কথা। জনক অবশ্য তাকে কোনো পাত্তাই দিল না। সরাসরি তাকাল সুভাষ মানের চোখের দিকে। সুভাষ মানও যে জনককে আজকে দেখছে তা নয়। তার শরীরের শক্তির সঙ্গে সে ভালোই পরিচিত। তাই আশুকেই বলল, “সোব সোময়ে ঝুটঝামিলা ভাল লাগে নাই।” তারপর তাকাল জনকের দিকে। বলল, “বল রে ব, বল। কী বলতে খুঁজচিস্ তুঁই?”

“আমার প্যাটে লাত মাইরে রব্যাকে কাজে লিলেন ক্যানে?”

“কী!” ঝপ করে থতমত খেয়ে গেল সুভাষ মান। ঠিক কী যে বলবে তাই খুঁজে পেল না। কিন্তু পোড় খাওয়া খেলোয়াড় সে। তড়িঘড়ি সে ভাবটাকে চাপা দিয়ে বলল, “স্যা কৈফিয়তটা কি তুখে দিতে হবেক্ নাকি রে ব? তুঁই কী অমন লাটের বাঁট বটিস্, আঁ?”

“লাটের বাঁট আপনিঅ অমন কিছু লন। আমি শুদু লিজের কানে শুইনতে খুঁজচি, যদি উয়াকেই লিবেন থাইলে আমাকে কুথা দিঁইছিলেন ক্যানে?”

“কুথা! তুখে?” আবার কথা হারিয়ে ফেলল সুভাষ মান। কোনো উত্তরই খুঁজে পেল না জনকের প্রশ্নের। বদলে খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসল। এলোমেলোভাবেই বলল, “ই বাবা, আমার কী দায় পড়িচে রে কুথা দিয়ার? তুঁই শালাই ত আমার পঁদে পঁদে ঘুরে বুলছিলি! শালা ছুটুলোক থাইলে আর কাখে বলিচে!”

“মু সামলাঁই কুথা বইলবেন বইলে দিলম।” ঝট করে লৌহরক্ত ছলকে উঠল জনকের ধমনিতে। হাতখানা মুঠো হয়ে এল। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল বুকের জ্বালাটা। বলল, “নাইলে বাবু বইলে আজকে আর খাতির কইরব নাই।”

কিন্তু গরিব মানুষের এতবড়ো হুংকার সহ্য করার মতো নমনীয়তা কোনোকালে তৈরি হয়নি– না সুভাষ মানের, না আশু সিংহের আর না তাদের মতো মানুষের। তার উপর সুভাষ মানরা একসময় ছিল এ অঞ্চলের জমিদার। সেই সুবাদে এখনও বাবু সম্বোধন পেয়ে থাকে আম-মানুষের। সুতরাং যাদেরকে মানুষের মর্যদাই দেওয়া হয়নি কখনও তাদের আবার নিজেদের কথা কী! তারা তো শুধু হুকুম তামিল করবে। খেতে-খামারে মুনিস-কামিন খাটবে। বাবুদের বাড়ির অনুষ্টানাদিতে এঁঠোকাটা তুলবে। ফেলে যাওয়া খাবার খুঁটে খাবে। মিছিলে মিছিলে শ্লোগান তুলবে। প্রয়োজনে লাঠি ধরবে। বোমা বাঁধবে। ইঙ্গিত অনুযায়ী ছুঁড়ে মারবে সে সব। কিন্তু জনক এ আজ কী করে বসল! সে যে মানুষের দাবি নিয়ে পথ আগলেছে বিজয়ীদের! এতবড়ো অপরাধ কি ক্ষমা করা যায়! তাই আশু দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। দৌড়ে এল জনকের কাছে। তার বুকে সজোরে একটা ধাক্কা দিল। বলল, “নাইলে কী করবি রে ব তুঁই, আঁ?”

“হাঁ ভাল, গায়ে হাত লাগাস্ নাই বলে দিলম।”

“লাগাব। ব্যাশ কইরব। একশবার লাবাগ। দেখি তুঁই আমার ক’খি ছিঁড়ে লিস্। শালা পায়ের জুতার মাথাতে উঠবার সাদ লাগিচে, লায়!” আবার একটা ধাক্কা দিল জনকের বুকে। অমনি জনকের মাথায় ছলকে উঠল পাথরগলানো রক্ত। সে-ও একটা ধাক্কা মারল আশুর বুকে। তাতেই আশু চিত হয়ে পড়ল শুঁকনো মাটিতে। জনক দাঁতে দাঁত ঘঁষে বলল, “থাইলে ল্যা। দ্যাখ কিছু কইত্তে পারি না লারি।” চেপে বসল আশুর বুকের উপর। দু’হাতে চেপে ধরল তার গলাটা। বলল, “শালা, মরদাঙ্গী মারাচ্চিস্ আমার সঙে, আঁ! জনকা নুয়ারের সঙে! জানিস্ নাই কার রক্ত বইচে আমার বুকে! আজ শালাকে মারেই ফেলব। দেখি তুর কন বাপ আইসে বাঁচায় তুখে।”

মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে যাওয়ায় হকচকিয়ে গেল সুভাষ মান। কিন্তু পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে পেল। দৌড়ে গেল জনকের কাছে। তার চুলের মুঠি ধরে বলল, “ছাড়, ছাড় শালা! মইরে যাবেক্ যে রে!”

“মরুক! একবারেই মরে যাক শালা হারামির বাচ্চা!”

ততক্ষণে আশুর মুখ দিয়ে গোঙানি বেরিয়ে এসেছে। সুভাষ মান চুলের মুঠি ছেড়ে ঝাপটে ধরল জনককে। টান দিল গায়ের সমস্ত শক্ত লাগিয়ে। কিন্তু একবিন্দু নড়াতে পারল না। শক্তিতে পারা যাবে না বুঝে ছেড়ে দিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে তুনে নিল একটা মাটির ঢেলা। সেটা সজোরে মারল জনকের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে ঢেলাটা গুঁড়ো হয়ে গেল। জনকও ছেড়ে ফেলল আশুর গলা। একঝটকায় উঠে দাঁড়াল আশু। কাশতে কাশতে জামার তলায় হাত দিল। তলপেটের কাছে গুঁজেরাখা যন্ত্রটা বের করে আনল। নলটা ঠেসে ধরল জনকের কপালে। বলল, “শালা, দুব– দুব ন’টাই শ্যাষ কইরে! দুব?”

“ছাড়, উয়াকে ছাড়ে দ্যা। অখন খুনখারাপি ভাল কাজ হবেক্ নাই।” সুভাষ চেপে ধরল আশুর হাতখানা। আশু গোঁয়াড়ের মতো মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “না ছাড়ব নাই। শালাকে আজ যমের ঘরকে পাঠাঁই তবে দম লুব। শালা কামার‍্যা, এত বাড় বাড় তুর! আমার গায়ে হাত তুল্লি! জাতে রোজপুত আমি। বল, দুব চালাঁইয়ে?”

“আঃ, আশু!” বেশ জোরের সঙ্গেই ধমকে উঠল সুভাষ মান। তাতে কাজও হল। আশু সরিয়ে নিল যন্ত্রটা। হাঁপাতে হাঁপাতে সেটাকে ঢুকিয়ে রাখল জামার তলায়– তলপেটে। কটমট করে তাকাল জনকের দিকে। জনক আর কিছু বলল না। কিছু করারও চেষ্টা করল না। মাথা নামিয়ে বসে থাকল চুপচাপ। শুধু বুকটা কামারশালার হাপরের মতো ওঠানামা করতে থাকল। সুভাষ মান বলল, “কাজটা তুঁই ভাল কইল্লি নাই জনকা। আমিঅ দেখে লুব তুঁই কী কইরে নিমাই মড়লের চাষ করিস্! শালাকে যদি ভাতে না মারিচি ত আমি রোজপুতের ছাঁ লই রে শালা! চলে আয় আশু।”

গজরাতে গজরাতে বাইক চালিয়ে এগিয়ে গেল তারা। জনক এবার মাথা ঝুঁকিয়েই ঘাড় ঘোরাল। তাকাল তাদের দিকে। হালকা হাসির একটা রেখা খেলা করে গেল তার কষে। এই সময় পুকুরটার কাদাজল ছেড়ে উঠে এল কুকুরটা। হাউ হাউ করে তেড়ে গেল ঝোপের দিকে। কিন্তু কিছু না পেয়ে ফিরে এল জনকের কাছে। তার কোমরটা শুঁকতে শুঁকতে কুঁই-কুঁই শব্দ করল। সেই শব্দকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল গ্রীষ্মশেষের তপ্ত বাতাস।