পথের কবিতা

দেহি পদপল্লবমুদারম্

জয়দীপ রায়

 

জয়দেব মেলায় এবারও খুব ঠান্ডা ছিল। আমাদের গাঙ্গেয় অঞ্চলে শীত কমে গেলেও আমি জানতাম জয়দেবে সেই কাঁপুনি থাকবে। টুকাই বাড়ি থেকে বেরনোর সময় শুধু ক্যামেরার ব্যাগটা নিয়ে বেরোচ্ছিল। তাড়া মেরে বললাম, সারা রাতের কেস। অজয়ের পাড়ের কনকনে হাওয়া। ইনার পর। জ্যাকেট নে।

দুর্গাপুর থেকে বাপনকে নিয়ে জয়দেবের পার্কিংয়ে পৌঁছলাম রাত সাড়ে দশটা। রাণা অবাক। রাত সাড়ে দশটাতেও মেলা দেখা শুরু করা যায় !

এপার থেকে নদীর উপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে মেলায় যেতে হয়। চওড়া জলহীন অজয়ের নদীখাত। এপার থেকে দূরের মেলার একটা গভীর আওয়াজ ভেসে আসে। সমস্ত শব্দ একসাথে মিশে সে এক দূরের যতিহীন কোলাহল। এই আওয়াজটাই টানে মানুষকে। এই আওয়াজ থেকে প্রতিটা সুরকে আলাদা আলাদা করে শোনার জন্যই মানুষ তড়ি-ঘড়ি নদী পার হয়। শনশনে হাওয়ার মধ্যে খেয়াল করতে ভুলে যায় নদীতে জল আছে কিনা।

জয়দেব মেলায় মানুষ একবার ঢুকে গেলেই হারিয়ে যায়। একের পর এক আখড়ায় ঢুঁ মেরে দেখে নেয় কোথায় খুঁজে পাওয়া যায় নিজেকে। করকরে স্বরের পদাবলী কীর্তনীয়ার মঞ্চ পেরিয়ে যায়। গরম জিলিপির কড়াইয়ের পাশ দিয়ে বাঁদিকে ঘুরে দেখতে পায় একটা আগুন ঘিরে দুজন সাধু আর কিছু অনুচর বসে রয়েছে। হাতে হাতে কল্কে ঘুরছে। লে বেটা, আগন্তুকের দিকে কল্কে এগিয়ে দেয় জটাধারী। যে মানুষের এখানেও হারানো প্রাপ্তি হয় না সে বেদম বিষম খায়। টলতে টলতে বেরিয়ে গিয়ে ভিড়ের টানে ঢুকে পড়ে এক পদাবলী কীর্তনের আখড়ায়। নেচে নেচে যে গায়িকা অসাধারণ পালা করে চলেছেন, তাঁকে যার রাধা মনে হয়, সেই হারানো মানুষটি অবশেষে নিজেকে মেলার ভীড়ে খুঁজে পান। বসার প্রস্তুতি নেন।

যতবার জয়দেবে এসেছি, দেখেছি সারারাত গায়ে গা মানুষ স্রোতে হেঁটে যাচ্ছে। আর কি যেন একটা খুঁজছে। প্যান্ডেল হপিংয়ের জমানায় আখড়া হপিং করে যাচ্ছে। একের পর এক আখড়ায় ঢুকছে আর বেরিয়ে আসছে। সেই বাউল পাচ্ছে না, যে রকম আর কখনও পায়নি। সেই কীর্তন শুনছে না যেমনটি আর কখনও শোনেনি। সারারাত আমিও মানুষের স্রোতে হেঁটে যাই। আর খুঁজতে থাকি এই এত মানুষ কি খুঁজে যায়! সারারাত ধরে আখড়ায় আখড়ায় বাউলরা নেচে নেচে গান করে চলে, মঞ্চ থেকে মঞ্চ ভরে ওঠে সেরা পার ফরমেন্স এর কীর্তনে নৌকাবিলাস বা রাধার মানভঞ্জনে। যে যেখানে আটকে যায়, বসে পড়ে। যার সন্তুষ্টি কম, সে আবার স্রোতে ভাসিয়ে দেয় নিজেকে। অজয়ের পাড়ে সারা রাতের মানুষের স্রোতে।

একটা আখড়ায় ঢুকে দেখি গান নেই কোনও, কিন্তু গামলায় গরম খিচুড়ি রয়েছে। আখড়ার লোকজন ধুলোর মধ্যেই শালপাতা পেতে দিল। বড় শালপাতার পাতা। গরম খিচুড়ি আর আলুর ঝোল। চাটনিও। শরীর যাবতীয় শক্তি সঞ্চয় করে নিল। সারা রাত হেঁটে যাবার, দাঁড়িয়ে থাকার এনার্জি। বাইরে বেরিয়ে সিগারেট ধরানো হল। কোনও কোনও আখড়া থেকে অসাধারণ সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসে। ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় দর্শক শ্রোতা সব মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে আর ক্যাসেটে গান বাজছে। একটা আখড়ায় এক অখ্যাত বাউলের গান থামিয়ে দিয়ে ঘোষণা হল, আমাদের মধ্যে এসে গেছেন সেই দূরদর্শন ও বেতারের শিল্পী যিনি সারা দুনিয়া ঘুরে গান গেয়ে বেড়ান। ঘোষণা শেষে সস্তার বাউল যখন মাইক ফিরে পেলেন, কি দাপট তার দোতারার! যেন জীবনের সেরা গানটি তিনি এবার করবেন নেমে যাবার আগে।

হঠাৎ দেখি টুকাই নেই। খোঁজা শুরু করার আগেই ফোন। জয়দীপ দা, সামনে চলে এসো। পেইছি। শ্মশান ছাড়িয়ে তিন চারটে আখড়ার পর ডান দিকের গলি। চললাম। মাইকের আওয়াজটা এদিকে একটু কম। আওয়াজের মারামারিটাও কম। একটা মাইকে অসাধারণ এক কন্ঠ ভেসে আসছে। ক্লাসিক্যাল ভয়ে সে পদাবলী কীর্তন। পৌঁছলাম সেখানে। এত অপূর্ব গাইছে যে প্রথমে ভাবলাম রেকর্ড বাজছে। সামনে গিয়ে দেখি চারজন যুবকের একটাদল। মূলগায়েন সেজে গুজে সামনে বজ্রাসনে বসে। বাঁদিকে খোল। পিছনে একজন সিন্হেসাইজার আর একজন কাঁসা। পিছনের দুজনই গান ধরেছে। এ ছাড়ছে ও ধরছে। কাওয়ালির মতো। কম বয়সী ছেলে দুজনই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো জায়গা খুঁজে বসে পড়লাম আমরা। টুকাই শুধু বলে উঠলো, কি এ! মরে যাবো নাকি জয়দীপ দা ?

বেঁচে গেলাম আমরা। বেঁচে থেকেই মরে গেলাম বা মরে গিয়ে বেঁচে উঠলাম আমরা চারযু বক। শেষরাতে অজয়ের পাড়ে এক অগ্নিকুন্ড খুঁজে পেলাম আমরা। দোয়ারকিতেই বুঁদ হয়ে গিয়ে রাত শেষ করলাম জয়দেবে।

মেলা শেষ করে যখন উঠে দাঁড়ালাম, রাত চারটে বাজে। না কি ভোর! মানুষজন অজয়ের জমে থাকা জলে নেমে গেছে। চান করতে। কাল ভোরে মকর সংক্রান্তি ছিল। কিছু পুণ্য আজও নিশ্চয় থেকে থাকবে। কিছু রেওয়াজ। আমরা যুগ-যুগান্ত ধরে চলে আসা অবগাহন দেখতে দেখতে মাটির বাঁধের রাস্তা ধরে ঘরমুখী। একজন নদী থেকে এক বোতল জল ধরলো। আমরা গিয়ে বোতলের সামনে হাত পাতলাম। আঁজলা করে জল নিয়ে মাথায় দিলাম। মুখেও মাখলাম।

-কোথায় বাড়ি দাদার ? জলবাহককে জিজ্ঞেস করি।

-পুরুলিয়ায়।

-জল নিলেন কেন?

-আর পরেরবার আইসতে পারি কিনা ঠিক আছে!

-কত বছর আসছেন?

-বাসের ভাড়া যখন পাঁচ টাকা ছিল তখন থিকে।

-তা, কত বছর হবে?

-কত বছর তো বইলতে পারবো না। তবে তখন দুর্গাপুরটেশন থিকে বাসভাড়া পাঁচ টাকা ছিল। এখন পঁয়তিরিশ টাকা।

-কি দেখলেন মেলায়?

-কত্তকি! কেউ গাইছে, কেউ নাইচছে। কেউ লাভ কইরছে, কেউ লোসকান। কত মানুষ কাঁইদছে, হাইসছে। ভরে গেল ভেতরটা। জানেন তো, বাবার সাথে প্রথম এইসেছিলাম। তাইর পর থিকে নাআইসলে মইনটা সারা বছর খারাপ থাকে। কি যেন একটা পাইনি মইনে হয়।

রসিকের পঁয়ত্রিশ টাকার বাসে হর্ণ দিল। লোকটা আমাদের ছেড়ে বাসে গিয়ে উঠলো। আমাদেরকে কানায় কানায় ভরে দিয়ে পিছনে ছেড়ে আসা মেলাপ্রাঙ্গন, ভুলে যাওয়া নদী সব আস্তে আস্তে দিনের আলোয় ভরে যেতে লাগলো। যেখানে যত পৃষ্টা তখনও সাদা ছিল, সব জায়গায় লেখা হতে থাকলো, দেহি পদপল্লবমুদারম্। কবি জয়দেব খানিক পরে অজয়ে স্নান সেরে দুটো খেতে বসবেন।