এপ্রিল ২০১৯

তরুণ কবির আলো

সুব্রত মণ্ডল

সুব্রত মণ্ডলের জন্ম ১৯৮৮ সালের ৯ই জানুয়ারী,  

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ময়না থানার অন্তর্গত কালিকাদাঁড়ী গ্রামে।

ইমেল: [email protected]


দ্যান বেটার-বেটার দ্যান

এ বাড়িতে যত দুঃখ ছিল

বসন্তের সঙ্গে সকলে চলে গেছে

এখন পাশাপাশি সুখ আর অসুখ

এক বিছানায় চুপি চুপি ধ্যান করে

মাঝরাতে বাইরের দেওয়াল ফুঁড়ে

শব্দ আসে নেচে নেচে

দ্যান বেটার-বেটারদ্যান

এমনই এক গোলাপী শব্দ করতে করতে

নদীকে ওই রাতে ফুলে উঠতে দেখে

থ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম

সেই কবে ভুতুড়ে জাহাজের নাম শুনেছিলাম দাদুর ডাইরিতে

ডায়াবেটিসের মতো দুপ করে ডুবে গিয়েছিল সেই দুপুর

পড়ন্ত বিকেলে জাহাজের ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন এসে জানিয়েছিল

দ্যান বেটার-বেটার দ্যান

একটা বিকেল হাতে ক্যাপ্টেনকে প্রথমবার হারতে দেখেছিলাম আমি

দাদু ওই সামুদ্রিক ফনা লুকানোর জন্য সুখ নিয়ে যত উপরে উঠেছে

নীচের বারান্দাতে চিৎকারে ফেটে গেছে পড়শির ঠোঁট

দ্যান বেটার- বেটার দ্যান ,আউচ…

সারা শহর জুড়ে উপচে পড়ছে শুধু ইংলিশ আর ইংলিশ

বসন্তের সঙ্গে সঙ্গে এ বাড়ির সকল চিৎকার আধুনিক হয়ে গেছে

আমরা এখন গাছতলায় বসে পাতা-ঝরার অপেক্ষা করি

 

হঠাৎ দেখা হলো যেদিন

রাস্তা পেরিয়ে এসে যে কয়েকটি পোড়া বাড়ি চোখে পড়ছিল

সে সকল মৃত প্রায়। এইটুকু চাওয়াতেও সূর্য নেমে এসেছিল।

উঠোনের সাদা খই উড়ে গিয়েছিল প্রান্তের তন্নীর গায়ে।

গোলাপী চোখ দিয়ে সরিয়ে রেখেছিল যাবতীয় পরিচয় তার।

সে আমার রক্তিম আভা।

                               

        কতটুকু চেয়েছিল?

কোন পথেএ সেছিল মালিনীর নিরামিষ রোদ ?

ভেবে ভেবে বাগিচাও মিশে গেছে অষ্টাদশী পুকুরের পাড়ে।

যেটুকু চেয়েছিল তুলনায় প্রবল বিবাদ।

সে ঝড় থেমে গেছে কবে! পুরোনো পাতার বনে

মিশে আছে আমাদের সেই পরিচয়।

দেখা হলে চোখে চোখ বসে। জল তার ছুঁয়ে আছে পুকুরের ঘাট।

পাতার প্রেয়সীর। নুপুরের নিক্কন পাড়ে উঠে আসে।

কতটুকু ডুবেছিল জানা নেই। শুধু ভেসেছিল পরিচয়টুকু।

কবেকার বেকার পাড়া।

স্মৃতি যেন চুরুটের টান,

যতটা নিবেড়ে যায় অপেক্ষার ঝুলন্ত সোপান।


 

 

 বিজয় দে

পোস্ট অ্যান্ড ডিস্ট্রিক টমনপুর

একটি টিয়াপাখি উড়ে গেল জংশনের দিকে

 

প্রথম সন্তান-জন্মের সংবাদ মুখে নিয়ে

একটি টিয়াপাখি যখন জংশনের দিকে উড়ে যাচ্ছিলো

তখন একটা অচেনা স্বপ্ন ঘুমচোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো

“কেন যে এত মুখে-ভাত, কেন যে এত মুখে ভাত, আকাশ কি এখনই

সাত-সকালে পাত পেড়ে পিঁড়িতে বসে পড়লো” ?

তখন আমার মা যাচ্ছিলো পুকুর-ঘাটে, মা যাচ্ছিলো গা’ ধুতে, মা যাচ্ছিলো

স্নান করতে আর তারপর ডুবজলে উলু দিতে দিতে

আকাশের গলা জড়িয়ে ধরে মা বললো “আমার পরাণ যা’ চায়

তুমি তো তাই, আয় এখন দু’জন মিলে জন্ম পাতাই”

তখন তোমার ও আমার লেখা প্রেমপত্রের শেষ লাইনগুলি

ঝিকমিক করে উঠলো

তখন লম্বা শালগাছগুলি আরও লম্বা হতে হতে

আকাশের শিরোনাম ছুঁয়ে ফেললো

তখন আমি তোমার সত্যি সত্যি তিন সত্যি

সত্যি চোখের জল হয়ে গেলাম

এবং আমাদের প্রথম স্নতান-জন্মের সংবাদ মুখে নিয়ে

একটি টিয়াপাখি জংশনের দিকে উড়ে গেল

একটি টিয়াপাখি উড়ে গেল গুমটিঘরের দিকে

বৃক্ষ থেকে আমাদের মাঝখানে সর্বাগ্রে নেমে এসেছিলেন যিনি,

তিনি আমাদের পক্ষীমাতা। এখানকার বিখ্যাত শিরিষগাছের ছায়াটি

আজ সেই পক্ষীমাতার নামে উৎসর্গ করছি

আমাদের এই পুরোনো হতমান বাড়িটির দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে

কেউ যদি আমার জন্য অপেক্ষা করে; ডানা ঝাঁপটায়

যদি তার অপেক্ষা হয় পালকের মতো স্বল্প ও মৃদু

যদি অপেক্ষা হয় চোখের প্রতিটি বিমূর্ত পলক

তখন পক্ষীমাতা সাক্ষী, প্রতিটি অপেক্ষাকে আমার

নিজের মা মনে হয়

জাতীয় সড়ক পেরিয়ে এলাম, রেললাইন পেরিয়ে এলাম, তারপর

ডাকঘর পেরিয়ে যখন ফিরে আসি, তখন দেখি

দূরদেশ থেকে পাঠানো মায়ের হাতে-লেখা একটি পোস্টকার্ড

ঘরের ভেতর শান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে

তারপর পোস্টকার্ডে লেখা ছুটির ঘণ্টাধ্বনিগুলি গুণতে গুণতে

একটি টিয়াপাখি উড়ে গেল গুমটিঘরের দিকে

 

একটি টিয়াপাখি উড়ে গেল রান্নাঘরের দিকে

“যার মন আছে সেইই টমনপুর”

কিম্বা যার মনের সর্বান্তকরণে অচেনা বাঁশির সুরে আঁকা

গো-চারণের মাঠ, সে নিশ্চিত টমনপুর

হে পুরোনো কবিতার লাইন, নতুন লেখার কাগজ হয়ে এসো

হে সাদা কাগজ, খোলা আকাশের গায়ে লেগে-থাকা

নতুন নক্ষত্রের ঘাস হয়ে এসো

টমনপুরের এটাই একমাত্র চির-আধুনিক গান, মনে রেখো

মনে রেখো, গাছের ঝর্ণাবাড়ি শিকড়ের কলমকারি

মনে রেখো মনে রেখো

এরকম বলতে বলতে একটি টিয়াপাখি

দিগন্তে বিস্তৃত প্রাণের রান্নাঘরের দিকে উড়ে গেল

 

 

 একটি টিয়াপাখি উড়ে গেল সবুজ ট্রলিব্যাগের দিকে

“টিয়া’রে একটা বিয়া দাও মা, আমরা সবাই মিলে

একটু রংবাতি জ্বালাই”

বিবাহ সুখের হয় ধমনীর গুণে; তোমার কি আমার কাছে

বিয়ের পদ্য চাইছো? তাহলে শুনে রাখো

টিয়াকেও বলতে পারো, লিখবো লিখব লিখব…

বিবাহের পদ্যে আবহমানের পালতোলা বাসর লিখবো

আর তারপর খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সব কাঁটাতারের গায়ে

কাঁচা হলুদ টানিয়ে দিতে আমার তো বেশি সময়

লাগার কথা নয়

পৃথিবী পুরোনো কিন্তু বিবাহ নতুন। টমনপুরের কলরব ওঠে

“অনেকদিন তো হোলো, এবার এ’পাড়ার সব মায়া-পড়শীরা

ডালে ডালে পাতায় পাতায় কুটুম্বিতার দিকে এগিয়ে যান”

দশকের পর দশক পেরিয়ে এসে এবারই প্রথম দেখলাম

সত্যিকারের সম্পর্ক

                                গেরস্থের আমগাছের শিয়রে বসে শিস দিচ্ছে

আর এই শিস-ধ্বনি মেঘের ভেতরে মেঘের নিচে মেঘের ওপরে

মেঘের পাশে পাশে রাজহাঁসের ছায়া উড়ে যাচ্ছে

আর সেই টিয়াপাখিটি নিজের বিবাহের পদ্য মুখস্ত করতে করতে

উড়ে আসছে আমার সবুজ ট্রলিব্যাগের দিকে


সুকৃতি

ধারণার মতো

শূন্যতা বলেও কিছু থাকে না যখন

সব পথ ধারণার মতো হয়ে যায়।

নিজেকে ভাবতে বসে এর বেশি কিছু

যখন পাই না খুঁজে আর, মনে পড়ে

তোমাকে আপেল, শেষে আমার টানেই

এসেছ কাশ্মীর থেকে হাতে হাতে হাতে…

চমক দেখলে বুঝি কতো কতো কতো

হাতের কামালে চকচকে হয়ে তুমি

ধারণার সাথে নিয়ে এসেছ কাশ্মীর।

আমার টেবিল জুড়ে একটা কাশ্মীর

ঝিলম নদীর মতো কবিতা লিখছে।


 

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

স্মৃতিভর্তি করাঘাত

আগুন জলের কাছে এসে বলে দহনের ব্যথা।

জলেরও বলার আছে, নানাবিধ, ভাসার বিষয়ে,

আছে তার প্রশস্তির বহুদূরে প্রস্বরভাবনা 

বিভিন্ন স্তবের শূন্য কীরকম জীবনে সম্মত!

আর এই বিপ্রতীপে ভাঙাভাঙা ধারণায় কেন

আগুন জলের কাছে… জল ও আগুন মুখোমুখি

এ- ওর ব্যথায় এসে অসম্মত, নীরবেই ঋণী

বসন্তবাসনা নিয়ে অনন্তের লিখেছে কাহিনি


রজতকান্তি সিংহচৌধুরী 

গাছেরা কবিতা

গাছেরা কবিতা 
পৃথিবী যা লিখে চলে
আকাশের কোলে

মানুষ সে-গাছ কাটে
কাগজ বানায়
শূন্যতায় শুধু ভরে তোলে।

নারী বিষয়ক

নারীকে তোমরা পাখি যদি ভাবো ঠিক 
ডানা কেটে তার নিয়ো না
নারীকে তোমরা নদী যদি ভাবো, ধিক্
স্রোতে বেড়া বেঁধে দিয়ো না।

ভালোবাসা

কখনও শরীর দিয়ে 
ক্বচিৎ আত্মায়

বিরলে সর্বশক্তিতে 
ভালোবাসা যায়

কারু কারু প্রেম 
আজন্ম নজরবন্দি মনের গুহায়।

 

তোমাকে

আমার সমস্ত বই
তোমাকে দেবই
আর দেব সমস্ত কবিতা

আমার সমস্ত জুঁই 
যার গায়ে লেগে আছে তোমার চুমুই
এখনও তোমারই প্রতীক্ষিতা।

 

 


 

 

 

স্বপ্ননীল রুদ্র

আশ্বাস 

রকমারি পুষ্টিকর ফল, শোভন-প্লেটে উজ্জ্বল

নোয়ানো নিরীহ ছুরি পাশে কারুময় বাট তার,

এই ছবি গায়ে পরে খাবার টেবিলের শরীরে

আলিঙ্গনের মতো বিছানো দামি প্লাস্টিককভার

 

পানীয় জলের একাধিক সারি সারি বোতলেরা

অনুগত ভৃত্যের মতন রঙীন উর্দি চাপিয়ে

বুক ভরা জল নিয়ে জীবন দানের প্রতীক্ষায়

জেগে আছে অহর্নিশ আত্মতৃষ্ণা সযত্নে লুকিয়ে

 

দুজোড়া লাল চেয়ার টেবিল কেন্দ্র করে ঘুরন্ত

তাদের আহ্নিকগতি নান্দনিক থালা বাটি গ্লাস

প্রত্যক্ষ করে জেনেছে অন্ন বড় অপচয়যোগ্য-

চেয়ে চেয়ে দ্যাখে শুধু মোহময় ভোজনবিলাস

 

একটি ছুঁচো মাঝে মাঝেই টেবিলে গভীর রাতে

প্রিয় অভিযান নিয়ে সুনিশ্চিত করে তার জয়,

মরচেধরা লবণদানির জমা দুঃখ নেড়ে চেড়ে

পুনঃসাক্ষাতের প্রতিশ্রুতি জানায় আশ্বাসময়…


 

অবিন রায়চৌধুরী

প্যারাডক্স

মহালয়ার দিন খুব ভোরে উঠে পড়তেন মা। ঘুম থেকে উঠেই আমায় ডাকতে শুরু করতেন-“বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র উঠে পড়েছেন, তুমিও উঠে পড়ো বাবু।” মহালয়া শুনতে শুনতে মায়ের চোখ বেয়ে নেমে আসতো নির্জন শিউলি ফুলের গন্ধ। সেই গন্ধের ভেতর শরীর ডুবিয়ে মা ধুয়ে ফেলতেন একটা সারা বছরের কালো,আতঙ্কিত দু’চোখের ভাষা। আমি ফ্যালফ্যাল চোখে দেখতাম-আমাদের মা সবার অলক্ষ্যে হেঁটে চলেছেন এক অপার্থিব ভোরের দিকে…পৌঁছাতে চাইছেন ওই ভোরের বুকে দুলতে থাকা মায়াবী সেতুটির শূন্যে…


কৌষিকী দাশগুপ্ত

মোহময়ী কাক

কথার ভেতরে কথা

কথা নয় শুধু অপচয়

ভেঙেচুরে দিলে তবে

কবিতারা প্রাণদায়ী হয়।

কোকিল ডেকেছে কত

পুড়ে গেছে মোহময়ী কাক

যদি না খুঁড়তে পারে

সেই লেখা ঘুমিয়েই থাক।

তেমন মানুষ কই

যার বুকে ভালোবাসা আছে

ভোরের আজান আজো

নতজানু শিশিরের কাছে

কথাকে গিলতে পারে

কোথায় সে অপরূপ ক্রোধ

ভাঙাচোরা কবিতারা

আসলে আমার প্রতিরোধ।


মধুসূদন দরিপা 

অযোধ্যা

‘রাধিকা থাকিলি বসি আপনার ঘরে’ 

অযোধ্যার চাতালে বসে ছবি আঁকে 

ললিতা বিশাখা রাধা 

বসন্ত মল্লার রাগে কাকিল্যার গোয়ালঘরে 

জেগে ওঠে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন 

‘বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জাণী

মোর মন পোড়ে যেহ্ণ কুম্ভারের পণী’

নাটমন্দিরে গান ধরেন জ্ঞান গোস্বামী 

‘আজি দখিনা দুয়ার খোলা’ 

পলাশরাঙ্গা কবির দল আবিরের তিলক কেটে 

বসে পড়েন আসরে 

বিকাশ দাসের কবিতা পড়তে থাকেন

অক্টোভিও পাজ 

‘কালো কালিন্দীর জলে যমুনা সিনানে 

অভিসারে চলেন শ্রীমতি 

অথচ শ্যামের বাঁশি কোথাও বাজেনি 

তবে কি শ্রীমতি নীল শাড়িতে সাজেনি 

পরেছিলো কালো ? 

ভালো সেই ভালো 

চ্ছলচ্ছল অন্ধকারে নৌকা ভেসে যায়’ 

‘ললাট লিখিত খণ্ডন না জাএ’ 

জমিদার বাড়ির বউ সন্তর্পণে 

অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে স্নানঘরে যায়

 

 


 

 

প্রতিমা রায়বিশ্বাস

গাছির গুড়িতে মাংস 

আমাকে  না বলেই দেখো তোমার সামনে থেকে সরে যাবে সব গাছ

ফালাফালা হয়ে প্রস্তুত হবে নলি কাটবার কাঠে

বিঘার পর বিঘা উন্মুক্ত হবে নপুংসক জমি

আর আততায়ী  চারাদের বিছানা পেতে রাখবে একদল চাষী।

মেকিকথায় উপার্জিত কিছু ভালোলাগা নিয়ে রমনীর কোমরে মোচড় খাবে এক খাল।

না বলেই দেখো তোমার গালময় উঠোন আর পুকুর চোখে চেয়ে থাকবে তুমি।

বন্দী জলে আকাশ হবে চাষ ,হোঁচট  খেয়ে পড়ে যাবে তার সব নীল।

ভ্রুপথ ধরে পশ্চিমগামী সূর্য ভাসান সেরে

তুমি তখন  ছিটিয়ে নিও রাত।


মৌ সেন 

কখনও কখনও ভয় পেতে শেখো

সব গাছ তো পলাশ নয়, 
পাতা ঝরে গেলেও বছর ঘুরলেই 
রুক্ষ্ম ডালে আবার ফুল ফুটবে,
আগুন রঙে ভরে দেবে পৃথিবী, 
এমনটা নয়। 

কিছু কিছু গাছে, 
পাতা ঝরে গেলে বুঝে নিতে হয় মৃত্যু আসন্ন ।

গাছ চিনতে শেখো, 
চিনে নাও মৃতপ্রায় জীবন । 
কখনও কখনও মৃত্যুকে ভয় পেতে শেখো। 


দয়াময় মাহান্তী

একটি অলটারনেট কবিতা

যে কোন বিশ্বাস তোমাকে নিয়ে যাবে প্রপাতের দিকে…

অথচ,কী আশ্চর্য একটা কোন বিশ্বাসকে আঁকড়েই 
আমাদের মরতে হয়–

              চোখের আলো চিরতরে ফিরিয়ে দেওয়ার আগে,

সবটুকু দৃষ্টির শক্তি দিয়ে খুঁজে নিতে হয় কিছু,মাথা রাখার মতো।

আমরা ক্রমশ ধ্যান ভুলে চঞ্চল,

যে যার মতো বিচ্ছুরিত হয়ে চলেছি,প্রলোভনে,ফাঁদে…
কেউ কেউ তার নাম রেখেছি খোঁজ,শ্রেষ্ঠের সন্ধান,

    কিংবা বৈচিত্র্যের পিয়াস

আমাদের গোরু চরায় যে ডোম

তার বউকে আমি দেখেছি মাঠে বসে

একসাথে কত কত বছর ধরে পান্তাভাত খেতে,

ডোমের হাতের আঙুলগুলো কুষ্ঠরোগের কারণে বেঁকে গেছে,

ডোমিনির হৃদয়ের ভেতরে তবুও কোন বাঁক আমি দেখি নি !—

ডোমিনি কি তবে যোগ জানে ? কী তার সাধনা ?

গতকাল আমাকে বলা হল,আপনাকে মঞ্চে এসে বলতে হবে,কী কবিতা, কেন কবিতা ? আসলেই এর উত্তর আমি যা বলব,তা শুনতে চেয়েই শ্রোতারা নড়েচড়ে বসবেন ? অথবা,যে উত্তর আগে থেকেই তাদের বুকে গাঁথা

তারই পুনরাবৃত্তি শুনতে চান তাঁরা ?  

আমি যদি বলি,একটা বিপজ্জনক পাহাড়ি রাস্তায় চোখ বন্ধ করে ছোটার নাম কবিতা। কেন ? কারণ আপনি অন্ধের মতো বিশ্বাস করছেন,যখন আপনি ছুটতে ছুটতে অত উঁচু থেকে অতলে পড়ে যাবেন,তখন সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাবে না,আসলে তখনই দপ করে জ্বলে উঠবে আলো ! 

শ্রোতারা সকলে কি আমার কথাটা নেবেন ? তাদের বৌ আছে,সন্তানের ভবিষ্যত আছে।সবচেয়ে বেশি অলটারনেট আছে।একটা অলটারনেট সম্পর্ক,যেকোনো কিছুর,রাস্তা থেকে আশ্রয়ের পরিবর্ত প্রস্তুত রেখেই তাঁরা জীবনে এগিয়ে চলেন,–অন্ধের মতো তাঁরা কি ছুটবেন,একটা বিপদসংকুল  পাহাড়ি পথে?

যেকোনো বিশ্বাস আমাদের তারপরও নিয়ে যায় একটা প্রপাতের দিকে…


শ্যামলী সেনগুপ্ত 

বদল
             

নদীটি পাশ ফিরতেই সংক্রমণ

দ্রূত  বেজে উঠলো
জলের পরমাণু ভাঙতে ভাঙতে
বালি আর বালি
লাল  সাদা   হলুদ   কালো
দ্রুত বদলে গেল কাঠামো                                          

মানুষ-জন আগে নদীর বুকে 

ভাসিয়ে দিত প্রেম আর আলিঙ্গন 
এখন নদীর নতুন ঠিকানা
জুড়ে তাদের বসত,
তার বুকের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে৷

কে যে কাকে  গ্রাস করেছে ! 


স্নেহাশিস পাত্র

কারিগর

 

না-হয় অনাদরেই বাঁচি। কেবলই কেন-যে জাস্টিস

খোঁজো ! ভেবেছো কি কোনওদিন দোয়েলের শিস

এত মধুর কেন? কিছু কর্কশ হলে চলতো কিনা

এমনও কি মনে হয়েছিল কখনও—তুমি বিনা

স্তব্ধ চরাচর

 

এতসব পূর্বাপর

ভাবতে ভাবতেই হাওয়া ছোটে অন্য কারও

পালে। অকর্ষিত পড়ে রয় তোমার—আমারও

আবাদভূমি

 

তবুও তো শুনি

সহসা রাত্রি ছিঁড়ে বেজে ওঠে ফোন

অডাক-কুডাকে ছুঁয়ে যায় যেন কোন

মোহনীয় স্বরে

 

তখনও আমার ঘরে

মাটির-কলস-ভরা বীজধানগুলি আকুলি-বিকুলি

করে। ভেসে যায় ক্লান্ত ডিঙি—ছেঁড়া পাল তুলি

জলীয় প্রতাপে

 

জীবনের মাপে

কিছুই হয় না আর—মাপেই জীবন গড়ি…


আলো বসু

শ্রাবণের গগনের গায়

শ্রাবণের বাইশ এলেই কোথা থেকে সেই পাখি এসে

ঘুমের মধ্যে চলতে থাকা জীবনটাকে জাগিয়ে দেয়,

ডান কাঁধ ঠুকরে দিয়ে বলে —‘’ আজ কি তবে আমার দিন ?’’

আমিও ছাড়বার পাত্র নই এমন দিনে যখন শ্রাবণ জলে স্মৃতিপাথর  ছুঁড়ছি আর

জীবন স্মৃতির পাতা উঠে আসছে তরঙ্গে তরঙ্গে , ভেসে উঠছে সেই

ছবি —ভেতর ভাঙছে পুত্র শোক আর বাইরে জ্যোৎস্নার হাসি ফেটে পড়ছে                                                              

 শোক কিছু না , মোমবাতির কাঁপা কাঁপা মুদ্রার দিকে এগিয়ে আসা একটা  ফু

ও পাখি তোকে হুস্ … দিলাম , জানিস না তুই কতটা গায়ে পড়া জীবন !

মৃত্যুর দূরবীনে চোখ রাখলে  হেলাফেলার প্রতিবেশি এখন তো আমি নাম না জানা

পালং পাতা রং ঝোপেরও ডাক নাম দিতে ছুটব !

পাখি তুমি অন্য কোনদিন এসো , বাইশে শ্রাবণ অন্তত আমাকে মৃত্যুভয় দেখিও না !


নিলাদ্রী দেব

হরিণ

 

অক্ষর অচেনা হরিণ

যে বনে রোদ দেয় চাঁদ

      সেদিকেই ছুটে চলে

                         বেকার যুবক

তারাগুলো লেগে থাকে

                             ভার্জিন চোখে

প্রেম পরজন্মের কথা বলে

মনে হয় মাতাল বাঁশি

কোনো এক সুরে তারাগুলো

             কবিতা হয়ে ওঠে

কবিতা!

কত কষ্টের পর হরিণ

             যুবকের মুখোমুখি হয়


বহতা অংশুমালী

কবিতা

দেবাদৃতা ঠেকিয়েছিল প্রথম আলতো আঙুল কাঁধের কাছে

আমি তখন

বল্মীকের

স্তুপে মগ্ন

আশিরস্কন্ধ তাই

শিউরে উঠতে লাগলো বছর দুই

পায়ের পথে ঘাড় অবধি আততায়ীর মতোন আঙুল এলে

বিমূঢ়তায় মানুষ দেখে পশু ও সুন্দরী

অনির্দেশ্য রোমাঞ্চে আহত

অথচ আজ রাতের কাছে অটিস্টিকের মতো

এইটুকু প্রার্থনা

জড়িয়ে ধরো সুনিশ্চিতে

বুকের মধ্যে রাখো পশু লোমের মধ্যে রাখো

মাফ করে দাও ছলাকলার পাঠ

সুরায় কি লাল চোখ ছিল তার?

ভুল সময়ের ফোন

এখনও আসলো না


তানভীর শাওন

সিঁড়ির কথা

মাঝে মাঝে সিঁড়িগুলো হয়ে ওঠে এক বুক,

ছুয়ে ফেলে কাঁধ, পুরোটা চিবুক।

হেলানো সিঁড়ি হয়ে যায় খুব খাঁড়া,

তবু ঠিক, যেনো বেখেয়ালে বিষফোঁড়া।

মাঝে মাঝে সিঁড়িগুলো ছড়ায় আতঙ্ক,

করে একচোট গতিভঙ্গ।

বুক ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিপাসা ধরায় খুব,

মন চায় পা আর না উঠুক।

মাঝে মাঝে সিঁড়িগুলো বুঝে ফেলে, ‘খুব তাড়া’

সিঁড়িগুলো হয় গতিতে আত্মহারা।

যেনো, চেপে বসে এক বেদুইন তার উটে,

বন্ধু, কিন্তু হয় না কভু ঝুঁটে।

মাঝে মাঝে সিঁড়িগুলো বুঝে নেয়, ‘মন খারাপ’

শ্লথ পায়ে যদিও থাকে না বিলাপ।

তখন, বিমর্ষ সিঁড়ি সমতলে মেলে পাখা

সারথির আর পায় না কখনও দেখা।


ঋজুরেখ চক্রবর্তী

ফলিত সন্ত্রাস

 

ধুধু স্বপ্নে কোনও রাতে অধুনার মৃত্যু ঘটে গেলে

আজন্ম স্মৃতির কাছে শুধু এক তামসিক দায় থেকে যায়।

করতলে দ্রাক্ষা আমি রাখিনি কখনও,

বিষের কৌটোয় রাখা কস্তুরীর ঘ্রাণ নিতে নিতে

অরূপ মায়ার যত অনাবিল লিপিরূপ

পাঠিয়েছি তোমার উদ্দেশে,

অমরত্ব খুঁজিনি সেসবে।

কী হবে প্রমাদে ভরা বীতলজ্জ পীত আড়ম্বরে

যদি না উলের কাঁটা যে-রহস্য বুনে চলে

তার সমপরিমাণ ওম আনে স্বচ্ছল প্রেরণা ?

রাত্রি সমাসীন হলে

ধুধু স্বপ্নে অধুনার হিম পড়ে ফলিত সন্ত্রাসে ।


অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

মনোহারি

শাটার উঠেছে আর শুরু হয়ে গেছে সংশয়

আজকে ক্রেতার দল আনবে কি যাযাবর বায়ু?

জারে জারে রাখা আছে দেহের অধিক কোনো ক্ষয়

যেভাবে প্রদীপে থাকে গত মানুষের পরমায়ু

সোনালি র‍্যাপার মোড়া ফিকে হয়ে আসা সাদা চোখ

সুতোয় ঝুলিয়ে রাখা মহামান্য আঙুলের কণা

পাউচের অন্ধকারে গুঁড়ো গুঁড়ো মিশে থাকা শোক

জানেনা কীভাবে পাবে দেহাতীত শোধের কামনা

এই তো অপেক্ষা শুরু। ব্রহ্মতালু ভেসে যায় ক্রোধে

ক্রেটের ভেতর এসে শুয়ে পড়ে কাচের হরিণ

পানীয়র থেকে আরো শীতল, বিষণ্ণ কোনো বোধে

সমস্ত ক্রেতার কাছে থেকে যায় অসামান্য ঋণ

তবুও শাটার ওঠে, বেজে ওঠে মনোহারি গান

এ জীবন কিছু নয় — খুলে রাখা দেহের দোকান


সুকান্ত শর্মা

একুশ এক মিলন

দেখা হবে প্রাক্তন !

বাংলা ভাষাতে

মুখোমুখি আমরা দু’জন !

তখন তোমার দিকে মাথা উঁচু করে তাকাব !

আর

বাংলাতেই বলব :

কেমন আছো চড়াই পাখি ?

কেমন আছে তোমার কিচির-মিচির মন?

দেখা হবে প্রাক্তন !

বিচ্ছেদ অলিখিত নিয়ম

আর অনেকটা বিরহ

যত্নে গড়া প্রেম বোকা অপেক্ষা রেখে যায় !

দেখা হবে প্রাক্তন !

বিচ্ছেদ-বিরহের অবশেষে

পাতায় পাতায় প্রেম নিয়ে

বাংলা ভাষার ইতিহাসে !


মলয় পাহাড়ি

ঝাঁটা 

অগনন আমার ছাত্রছাত্রী, স্ত্রী, পরিজন 

এমনকী সন্তান 

পায়ের ধুলো নিতে এলে সার্জেন্টের 

লালবাতি তুলে ওদের থামাই।  দেখিয়ে দিই 

ঘরের কোনে রাখা  নিত্যকার ঝাঁটাটি। বলি-

তোমাদের যত প্রনাম ওখানে রেখে যাও। 

ওরা আশ্চর্য চোখের হলে বড় অসহায় লাগে 

দিনান্তে ভেতরের মাধুকর ঝোলাটি উল্টে 

খুদকুটো নেড়েচ দেখে… 

কোন স্বর্ণকনা নেই তো, ভেঙে ভেঙে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার

স্বর জিভে এলো না তো! 

অন্ধকার কে সম্বোধন চিৎকার করে এখনো বলা হলো না -পোশাক

বদলাও,গায়ের কীট ধুয়ে ,ধুয়ে মাটি হও অন্তত একটু …

হাত আমার মাটি ছুঁতে পারে না, পা আমার মাটিতে পড়ে না,

আমার কন্ঠে কোন তীক্ষ্ণ ঝাঁটা-কাঠি নেই। 

শ্রান্ত সন্ধ্যায় আমার হাতে শ্রমণ উঠে আসেনা। 

তাই কখনও ঝাঁটার কাঠি জমাই একটি দু’টি করে… 

খুব লোভ হয় সেদিন টা আসুক, যেদিন বাচ্চারা 

ঝাঁটার পায়ে হাত রাখবে 

               আমি  তথাগতর …


মৃন্ময় চক্রবর্তী 

পান বরজের পাখি  

নীল শ্লেটের মতো আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালো 

কালো পাথরের মতো মানুষ। দুচোখে গভীর ব্যথা,

এতদিন পরে এলে? সেই যে বলে গেলে গাজনে আসবে,

আর তো এলে না!

সঙ মাস্টার ইয়াসিন গাজী মারা গেল।

ওর নাচ দেখে শিরিষের ফুল রাধার মতো পাগল হয়ে যেত।

আর কে সাজবে বলো শিব, কৃষ্ণই বা কে গাইবে আর? 

ছোকরারা এসবে আসেনা এখন। চুলে রঙ দিয়ে নবরূপী হয়। 

সমস্ত শিকড় গেছে ছিঁড়ে। বাঙলার পানের মতোই।

দেলে বা গাজনে লোক হয় না তেমন। অরকেস্টায় ডিজে বাজে।

আমি অপরাধীর মতো চুপ করে যাই।

দেখি পানের বরোজ থেকে দুটো ঠোঁটলাল পাখি উড়ে যায়।

ভিকুদার ভাস্কর্য শরীরে রোদ ঠিকরোয়।

বিড়ির সরল ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে সে বলে,

মনে আছে তালের রসের কথা? সেই যেবার এসেছিলে?

ঘন মধুর বুকে মাতাল মৌমাছির ভিড় দেখে মজা পেয়েছিলে খুব?

সেই গাছ ছাড়াবার শেষ লোকটাও পশ্চিমে চলে গেল। 

পেটের তাগিদের চেয়ে বড় তাগিদ তো আর কিছু নেই।

বিকেল ঘনালো এইবেলা। এসো, সন্ধের আগে মাঠ পার করে যাই।  

হরিরাম হালদার বিপত্তারিণির আটচালায় পাঁচালি গাইবে একটু পর।

বুড়ো মরে গেলে গ্রাম থেকে উঠে যাবে রামায়ণ।

একটা খটাস নিঃশব্দে ছুটে গেল আমের বনে। আটেশ্বরের থানের দিকে উড়ে গেল কয়েকটা কাক।

আমাকে নির্লজ্জ করে পোষাকের খাঁজে ডিজিটাল অনুষঙ্গে বেজে ওঠল জারজ শহর।


শাশ্বতী দাশগুপ্ত

মায়াশরীর

ত্যাগে তৈরী শরীর যেন নিভৃত শিশির!

অনুতাপ আর করুণার মতো পরাজয় মিশে থাকে রাত্রি উত্তাপে…

ক্ষতের দাগে ভরে আছে প্রবল প্রতীক্ষা,

স্তব্ধ ঘরে পড়ে আছে এক অতীত, ছায়ারা আর আসে না !

গন্তব্য সেই ধ্যানমগ্ন শূন্যতায়…

যেখানে কোনও অস্তিত্বের চলাচল নেই—নিরিবিলি জাগিয়ে রাখা

ছোট মোচড়ে মুহূর্তের ভুল মনে পড়ে,

একটা নিঝুম রাত ছিঁড়ে যায় স্বপ্নের আঁচড়ে !


অর্ণব সাহা

নিঃস্ব আত্মার ওভারড্রাফট

‘যাও’ নয়, বলতে হয় ‘আসি’…

প্রত্যেকটা বিচ্ছেদ থেকে, প্রত্যেকটা দূরত্ব ভেঙে

                                                 ফেলে

চেয়েছি তোমার কাছে ফিরে আসতে, ভুল,

                                     আহাম্মক

মুহূর্তের দাবি থেকে সময়নীলিমা

কাশী মিত্তিরের ঘাট, পার্ক স্ট্রিট কবরখানা হয়ে

কফি হাউজের সিঁড়ি, ট্যাক্সি-রাইডের সীমারেখা…

আর কবে সফল হবে দিনের রঁদেভ্যু ?

#

চেয়েছি তোমাকে আর প্রত্যেকটা পদছাপ নিয়ে

কেন সরে যাও তুমি ? কোথায় লুকোও ?

তোমার শব্দের নীচে আমার হৃৎপিন্ড আঁকা আছে !

কোথায় চলেছ তুমি ? কোন্‌ দিগন্তের অধিকারে

সিঁড়ি-ভাঙা অংক কষে পা ফেলছ নিজেকে হারাতে ?

বিষণ্নতা এক মধুর উপমা, তুমি ডুবে যাও বিচ্ছিন্ন

                                 ঘুমের ওষুধ

বুকে নিয়ে, যেখানে চুল-ঝাঁকানো দেবদারু গাছেরা

তোমায় কুর্নিশ জানায় । উচ্ছল হতে বলে :

“বেরিয়ে পড়ো হাওয়ায়, হাওয়া বাইরে থেকে আসছে”

সেই কবেকার বাসি কবিতার পঙ্‌ক্তি তোমার

                                        ঠোঁট ছোঁয়

আলগা আদরে সরিয়ে দেয় কপালের উড়ো চুল

অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতে তুমি টের পাও

অনেক দূরের এক মহানগরের ব্যস্ত সড়কে

কানে সেলফোন রাস্তা পেরোচ্ছে কেউ

তোমার উদ্বেগ তার বিষাদ, সে নিজের

কোটরে ঢুকে-যাওয়া এক রাত্রিচর, বিধ্বস্ত নাবিক !

স্টিমারের ভেঁপু বাজে । সন্ধে হয় । বিয়ার পাব

আর সস্তা কফিশপগুলোয় কারা যেন সেঁটে দেয়

                                   নির্জনতার পোস্টার…

অল্প মদেই নেশা হয় । ঘুমের সুড়ঙ্গে তলিয়ে

যেতে যেতে কেউ যেন বিড়বিড় করে বলে :

               “ভালোবাসি, ভালোবাসি…”

পুরুষ, তোমাকে দেখে যৌন উত্তেজনা আচমকাই

ঘটে গিয়েছিল । আমি সংযম রাখতে পারিনি…

তুমি বয়ে এনেছিলে পর্নোপৃথিবীর নীল মায়া

হাজার সরীসৃপ যেখানে দেয়াল বেয়ে নামে !

আমার শরীর থেকে তরল ব্যর্থতা ঠিকরে ওঠে

সত্তা নেমে দাঁড়িয়েছে অগভীর নাভির নীচটায়…

সেই অন্ধকারে বসে একজন তামাকপাতা জ্বালে

অন্যজন আগুনের উস্কানি চাপা দিতে চায় :

বাকিরা হাততালি দেয় । ক্যাম্পফায়ার । ভাঙাচোরা চাঁদ…

যাদের জীবনে কোনো ফার্স্ট লাভ নেই, সেকেন্ড

                                            লাভ নেই

রাজহাঁস ডানা মুড়ে বসে না যাদের উপত্যকায়

প্রায় নিভে-আসা মোমবাতির শিখা অপেক্ষায়

                                  থাকে তাদের !

যখন পানশালার দরজা বন্ধ হয় । সস্তা

মদের গন্ধ শরীরে জড়িয়ে, মন্থর পায়ে হেঁটে

                         ঘরে ফেরে তারা…

উপোসী শরীর ক্ষুধার্ত বাঘের চেয়েও ভয়ানক

অক্সিজেন-ফুরোনো পলিপ্যাকেটের মতোই

বিছানায় নেতিয়ে পড়ার আগে, কুঁকড়ে-থাকা

                  শিশ্নে মায়াবী আঙুল বোলানোর পর

তারা স্বপ্ন দেখে ১৭ বছর, ২২ বছর আগেকার

সেইসব দিন । যারা সোনালি আলোর অবসর নিয়ে

ধরা দিয়েছিল, অথচ, সেই আলোর গায়ে

কারুকার্য ফোটানোর মেধা বা ক্ষিপ্রতা কোনোটাই

 ছিল না তাদের…

২০০৫ সালে রাস্তায় নেমে এসেছিলাম । টের

পেলাম নিয়তি এক হাওয়ামোরগ । সব খেলার দান

পালটে দিতেই এসেছে সে বিভ্রমের আত্মা…

যা শিখেছিলাম তার পুরোটাই ভুল বুঝতে

কেটে গেল আরও এক দশক । এখনও

সিঁদুর-মাখানো পাথর দেখলে দেবদূত মনে হয় ।

ঢোঁড়া সাপ আর বিগ্রহ ঠাহর করতে পারি না !

আচমকা শৈশবের পাড়ায় হেঁটে গেলে বাড়িঘর

অহেতুক বেঁটে দেখায় । সময়সারণী ছাপিয়ে

আমরা বহুবার পৌঁছে গেছি মায়াশরীরের

ওপারে । এখান থেকে পিছনে তাকালে গোটা

অতীতকালই কুঁকড়ে-যাওয়া তুষারযুগ মনে হয়…

প্রত্যেকটা মধ্যরাতে আমার নবজন্ম ঘটে


সতীন্দ্র অধিকারী

ফুলবন 

১.

প্রকান্ড একটা নাক গলিয়ে এখন আর

কোনো কিছুই ইচ্ছে করে না

                                 জানতে

চরম নিস্তব্ধতার ভিতর যেভাবে

একজন বৈষ্ণবী খুঁজে বেড়ায় তার

                                    মানুষ!

যেখানে কান্ত ও কান্তা

                           দাস্যের সেবা

সখ্যের বিস্রম্ভ

                    নৌকা বিলাস…

হে সখা

তুমি আমায় ফুলবনে নিয়ে চলো।

২.

সমর্থা রতির মধ্যে যেভাবে নিহিত থাকে

পরকীয়া বীজ

সহজিয়া চন্দ্রাবলী!

যে প্রেমে বাধা নাই।

সে প্রেম কী প্রশয় দেয় তীব্রতার লাজঘর!

হে সখা : রূপান্তর নয়।

তুমি আমায় নিয়ে চলো ফুলবন…

৩.

যদি পারো

এসো…

শতশত বাসন্তী রজনীর বুকে

যেভাবে ঢলে পড়ে বাখুলের জল…

দেখি

রাধার তপস্যা

সারা রাত এই আহুতি প্রণয়কলা

হে সখা

এই নাও গৌড়ীয় প্রেমিকের

শেতাব্জ সুন্দর নির্মলতা…

তবু চলো সেই ফুলবন…

৪.

এখন যোগমায়া পৌর্ণ মাসীর চরনে বসে

থাকতে ইচ্ছে করে খুব।

রাত্রি চরাচর সেই সব নীলাভ চোখ…

এ মুক্তি না— আমার!  না— তোমার!

দেখি

প্রাজ্ঞ আত্মার সাথে মিশে থাকা পরমাত্মা

এ আলিঙ্গন কে না চায় বলো!

হে সখা

আলিঙ্গন করো আমায়।

দূরে কোথাও বেজে ওঠে বাঁশি…

চলো সেই ফুলবন!

৫.

দুঃখপূর্ণ জীবনে আর কি-ই বা আছে শ্রীরাধা।

যে যা খুশি বলুক

তা বলে তুমিও…

যার জন্মই তল্লা বাঁশের বংশে

কী লাভ ওকে দোষ দিয়ে!

যে অধর সুধা পান করে সর্বদা

তার কাছে তো সুধাই আশা করা যায়

পরের কথায় কে কবে ত্যাগ করেছে

নিজের জীবন!

হে সখা এসো

গুঞ্জার মালা হাতে দাঁড়িয়ে আমি তুমি ফুলবন


রত্না চক্রবর্তী মুখোপাধ্যায়

শূন্য হাত রয়ে যায় শুধু

 

ছুঁয়ে দেখি

          সেও এক প্রখর দ্যোতক–

 নিঃসীম, গভীর। পুষ্প করণ্ডক হতে

তিতীর্ষু মোহস্রোত ।অলকার তটস্পর্শী হাওয়া।

তবুও বিষাদ,

          তুমি ধমনী-রুধির-ধারা;

আমি এলোচুল,

            ক্রমাগত মুক্ত হয়ে পড়ি শূন্যের পাশে–

তপঃলব্ধ জপমালা তুলে রাখি, খুলে রাখি কথায় কথায়

তবু হে আয়ুষ্য,

দেখি তাম্রকুন্ড ভরে আছে প্রসাদে প্রসাদে…

 ‌ …           …             …            …

অনন্তর হাহাকার,

              এ মরণ আমার!

নিবেদিত ভোগ- অন্নে অভিষিক্ত দেবদেবীগণ

শূন্য পাত্র ভরে নিয়ে লোকান্তরে যান। 


শাঁওলি দে

রাত

অন্ধকারকে তুমি রাত নাম দিলে

আমি দিলাম ইশারা ,

তুমি ইঙ্গিত বুঝলে না

আমি অন্ধকারকেই জড়িয়ে নিলাম।

শহর জুড়ে রাত নেমে এল

দিগন্তে শুধু এক টুকরো লাল

আমি সিঁদুরের রঙ খুঁজলাম

তুমি ছড়িয়ে দিলে অবিশ্বাস

মুহূর্তই সব কথা বলে দেয়-

জোনাকি যেমন শোনায় রাতের গল্প

তারা খসে পড়তে কত সেকেন্ড লাগে বলো ?


রিয়া চক্রবর্তী

একদিন…

একদিন ব্যস্ততা অফিস থেকে ফিরে বলবে,

সময় তার ফুরিয়ে গেছে।

একদিন সময় পেরিয়ে যাওয়া

না-আসা টেলিফোন বলবে,

শেষ হলো এবারের মতো অপেক্ষার পালা।

একদিন ঠোঁটের সন্ধানে

চেনা ঘর-দোর পেরতে পেরতে বুঝবে হঠাৎ,

সব সেতু আদর গুটিয়ে নিয়েছে।

এভাবেই গ্রহণ লাগে…

ফেলে দিতে হয় রান্না করা

অভিমান, সোহাগ, ‘কিগো শুনছো’-র সব অন্নজল তখন…


ধারাবাহিক রচনা

আকাশের আড়ালে আকাশ

সুদীপ বসু

 

 ‘আমি কি ঘুমতে পারি তাকে ছেড়ে!’

 

 

                         আজিকে তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া রব দুয়ারে,

রাখিব জ্বালি আলো।

                         তুমি তো ভালো বেসেছ, আজি একাকী শুধু আমারে

                                      বাসিতে হবে ভালো।

                         আমার লাগি তোমারে আর হবে না কভু সাজিতে,

                                      তোমার লাগি আমি

                         এখন হতে হৃদয়খানি সাজায় ফুলরাজিতে

                                      রাখিব দিনযামী।

[‘পূজা’, বঙ্গদর্শন, ১৩০৯ ফাল্গুন]

 

                         গেলে যদি একেবারে গেলে রিক্তহাতে?

                         এ ঘর হইতে কিছু নিলে না কি সাথে?

                         বিশ বৎসরের তব সুখদুঃখভার

                         ফেলে রেখে দিয়ে গেলে কোলেতে আমার!

                         প্রতি দিবসের প্রেমে কতদিন ধরে

                         যে ঘর বাঁধিলে তুমি সুমঙ্গল করে

                         পরিপূর্ণ করি তারে স্নেহের সঞ্চয়ে

                         আজ তুমি চলে গেলে কিছু নাহি লয়ে?

[‘শেষ কথা’, বঙ্গদর্শন, ১৩০৯ অগ্রহায়ণ]

µ

                         এ বাড়ি যেদিন প্রথম এসেছিলেন নাম ছিল ভবতারিণী রায়চৌধুরী। যেদিন এ বাড়ি ফেলে শেষবারের মতো চলে যাচ্ছেন তদ্দিনে তিনি মৃণালিনী ঠাকুর নামে পরিচিত। মাঝখানে উনিশটা বসন্ত নীরবে হেলায় পার করে দিয়েছেন। অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার দক্ষিণডিহি-ফুলতলা গ্রামের শুকদেবের বংশধর বেণীমাধব রায়চৌধুরীর প্রথম সন্তান ভবতারিণির মায়ের নাম ছিল দাক্ষায়ণী দেবী। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বীরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী বিস্তর পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে জানাচ্ছেন তাঁর পিসিমার জন্মতারিখ ১-লা মার্চ ১৮৭৪ (১৮ই ফাল্গুন ১২৮০)। দক্ষিণডিহি গ্রামে কোনো বড়ো স্কুল নেই। তাই গ্রামের পাঠশালাতেই ভবতারিণীর শিক্ষা শুরু হয়েছিল। প্রথম বর্গ অবধি, সোৎসাহে পড়াশুনা চলল। কিন্তু পরীক্ষাকেন্দ্র বেশ দূরে। সেখানে একলা নারী প্রকাশ্যস্থানে পরীক্ষা দিতে বসলে লোকলজ্জার ভয় পায়ে পা জড়িয়ে যায়। তাই ওইখানেই বিদ্যাশিক্ষার ইতি টানতে হল।

                         রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু প্রিয়নাথ সেন ১৮৮৩ সালের নভেম্বরের শেষাশেষি রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে লেখা একটি চিঠি পেলেন। চিঠি কেবল নয়, রীতিমতো আমন্ত্রণপত্র। বিয়ের নেমন্তন্ন। তাতে লেখা -‘প্রিয় বাবু – আগামী রবিবার ২৪-শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬ নং যোড়াসাকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন। ইতি

অনুগত

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’

                         ১২৯০-এর ২৪-অগ্রহায়ণের (ইং ১৮৮৩-র ৯-ই ডিসেম্বর) এই বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী। পাত্র – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিবাহবাসর ৬ নং জোড়াসাঁকো, কলকাতা। পাত্রী – ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী বেণীমাধববাবুর কন্যা ক্ষীণতনু, চাপাগাত্রবর্ণ, বাহ্যত অসুন্দর ন’বছর আট মাস আট দিন বয়সী ভবতারিনী। পাত্রটির বয়স তখন বাইশ বছর সাত মাস ছুঁই ছুঁই। অর্থাৎ বিয়ে হ’ল প্রায় তেরো বছর বয়সের ফারাকে। উঠতি যুবক বিয়ে করল পাঠশালাফেরৎ নাবালিকাকে।।

                         রবীন্দ্রনাথের এক গোঁ, তিনি কোথাও যাবেন না –‘এখানেই বিয়ে হবে’– তাই তাঁকে বিয়ে করতে বরযাত্রীসহ শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়নি। বিয়ে হয়েছিল জোড়াসাঁকোতেই। বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলের বিয়ে কিন্তু খুব একটা ঝকমারি ধূমধামের উৎসব হয়নি। ওইদিনই শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি সৌদামিনী অকস্মাৎ স্বামীহারা হন। এই পারিবারিক বিপত্তি বিবাহবাসরের আনন্দ মাটি করে দেয়। হেমলতা দেবীর লেখায় পাই ঠাকুরবাড়ির পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করতে এসেছিলেন, বরসজ্জার চোখধাঁধানো শাল গায়ে জড়িয়ে। রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন পিঁড়ির ওপর। সেখানে স্ত্রী আচারের সরঞ্জাম প্রস্তুত করাই ছিল। তাঁকে বরণ করে নিয়েছিলেন মৃণালিনীর এক আত্মীয়া যিনি ‘বড় গাঙ্গুলির স্ত্রী’ নামেই পরিচিতা ছিলেন। নিছক রসিকতাবশেই কি পাত্র রবীন্দ্রনাথ ভাঁড়-কুলো খেলবার অছিলায় ভাঁড়গুলোকে সব ধরে ধরে উল্টে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর জীবন যে ওলোটপালোট হয়ে যাবে এই ইশারায়? সে যাই হোক বাসররাতে কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরীর আদেশে গান ধরেছিলেন তিনি –‘…. নেহারিয়া রূপ হায় / আঁখি না ফিরিতে চায়, / অপ্‌সরা কি বিদ্যাধরী / কে রূপসী নাহি জানি।’গান গেয়েছিলেন ঠায় বালিকাবধূ মৃণালিনীর দিকে চেয়ে চেয়ে। বাইশোত্তীর্ণ পুরুষের এই লোকলজ্জার মাথাখাওয়া কান্ডকারখানা দেখে লাজে ভয়ে ত্রাসে আধো বিশ্বাসে ওড়নার অন্তরালে নববধূর মাথা একেবারে হেঁট।

µ

                         রবীন্দ্রনাথের আড়ম্বরশূন্য বিবাহরাতের বর্ণনা এখানে এমন ঘটা করে করবার একটাই কারণ – ওইদিনে ওই মুহূর্তে ন’ বছরের মৃণালিনী জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে প্রবেশ করেছিলেন। মহর্ষিভবনের ব্রহ্মোৎসব দালানে কুলপ্রথানুসারে বাড়ির সবচেয়ে ছোট বউ হিসেবে তাঁর দ্বিধা থরোথরো অভিষেক হয়েছিল ওই ২৪শে অগ্রহায়ণের (১২৯০) হিম সন্ধ্যায়। আর আজ ‘আকাশের আড়ালে আকাশ’ জুড়ে শুধু বেজে উঠবে ওবাড়ি ছেড়ে তাঁর চলে যাওয়ার বিদায়বাজনা। এমনই আর এক অঘ্রাণে, উনিশ বছর পর। নীরবে, নির্জনে। দেখব অকাল অসুখ একান্নবর্তী পরিবারের মায়ার সব দড়িদড়া ছিন্ন করে তাঁকে নিয়ে চলে যাচ্ছে জীবনের মাঠ ভেঙে ভেঙে মৃত্যুর কুয়াশাপ্রান্তরে।

                         ১৮৯৯-এর ২১-শে অগাষ্ট শিলাইদহ থেকে মেয়ে মাধুরীলতার একটি চিঠি পান রবীন্দ্রনাথ। তিনি তখন জোড়াসাঁকোয়। ‘বলুদাদা কেমন আছেন? মা দিন চার পাঁচ থেকে কেঁদে কেটে অস্থির। নাওয়া-খাওয়া একরকম বন্ধ করেছেন। মামা বোঝাচ্ছেন যে শুধু দুর্বল থাকলে কোনো ভয়ের কারণ নেই। আজ তোমার চিঠি পেয়ে চুপ করে রয়েছেন।’ চিঠিরতারিখ ২১। তার দুদিন আগেই বলুদাদা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯-শে অগাষ্ট মাত্র উনতিরিশ বছর বয়সে মারা যান। যাকে বলে বন্ধু, রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় যাকে ‘চিরসখা’ বলে, মৃণালিনীর কাছে বলেন্দ্রনাথ ছিলেন তাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্বামী, তাঁর পাঁচ সন্তানের পিতা, তাঁর অভিভাবক, ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলে, এছাড়াও তিনি ব্রাহ্মসমাজের হর্তাকর্তা, ডাকসাইটে কবি। কিন্তু ন’বছর আট মাসের শিশুকন্যার প্রকৃত বন্ধু কি তিনি? অথবা কতদূর মর্মসহচর? রবি-মৃণালিনীর আমৃত্যু মানসিক দূরত্বের কথা আজ নয় বিতর্কের ঘরে তোলা থাক। কিন্তু এ সত্য তর্কাতীত যে মৃণালিনী ঠাকুরবাড়িতে একান্ত অন্তরঙ্গতায় বন্ধু হিসেবে কাছে পেয়েছিলেন তিন বছর চার মাসের বড় বলেন্দ্রনাথকে। সংস্কৃত, বাংলা বা ইংরেজি যখন যে ভাষায় যে কোনো বই পড়তেন বলেন্দ্রনাথ, কাকিমাকে একবার পড়ে শোনাতেন। কাকিমার প্রাণের কথা বারবার তাঁর শোনা চাই। মৃণালিনীর কাছেও মন খুলতে পারতেন বলেন্দ্রনাথ। যে মানুষটা ছিল তাঁর ধূসর আত্মার মুক্তির প্রান্তর তাঁর অসময় আচম্বিতে চলে যাওয়াটা কোনোদিন মন থেকে মেনে নিতে পারেননি মৃণালিনী। বলুর মৃত্যু তাঁকে শোকে তছনছ করে দিয়েছিল।

                         বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুর তিন বছর তিন মাসের মাথায় এ মরপৃথিবীর বাঁধন ছাড়িয়ে চলে যান মৃণালিনী, সেই একই বয়স অর্থাৎ উনতিরিশে। কিন্তু এই তিন বছর তাঁর কাটল কেমন করে? ১৯০১ পর্যন্ত শিলাইদহে কাটিয়ে চলে আসেন কলকাতায় ও শান্তিনিকেতনে। ও বছরই খুব দ্রুততার সঙ্গে দুই মেয়ে মাধুরীলতা (১৫ই জুন) ও রেণুকার (৯-ই অগাষ্ট) বিয়ে হ’য়ে যায়। ১৯০১-এর ২২-শে ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। আশ্রমটি তিলে তিলে গড়ে তোলার কাজে তনুমনসমর্পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মৃণালিনী। কবির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজের গয়নাগাটি বিক্রী করে দিয়ে তিনি আশ্রম ও বিদ্যালয় গড়ে তোলার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। আশ্রমের ছাত্ররা, ঘরছাড়া ছেলের দল সব, তাঁর মধ্যে মায়ের আশীষের সুলুকসন্ধান পেয়েছিল। তাদের খাওয়াদাওয়ার তত্ত্বাবধান তিনি নিজের হাতে করেছেন। রথীন্দ্রনাথের মতে জোড়াসাঁকোর আত্মীয়-স্বজন মুখরিত বিরাট পরিবারের উৎসব কলরবের আবহ পিছনে ফেলে, আসর মাত করে রাখা ছোটবউ এই শান্তিনিকেতনের রুক্ষ বিজনে যথেষ্ট অসুবিধার ভেতর পড়েছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু রবি ঠাকুরের স্বপ্নকে রক্তমাংসের করে তুলতে তিনি তুলনাহীন কায়িক শ্রম করতেন। যে তরুণী বালিকাবয়স থেকে সংসারসাজানোকেই জীবনের ধ্যানজ্ঞান করে তুলেছিলেন সেই তাঁকেই অস্থায়ী অতিথিশালার মেরামতহীন ছাদের নীচে প্রায় শূন্য থেকে চটজলদি সংসার বানিয়ে নিতে হয়েছিল। অন্যের স্বপ্নপূরণ করার খাতিরে নিজের সংসারকে বিশ্বসংসারের সঙ্গে জুতে দেওয়ার বেদনা বড় কম নয়। কিন্তু তা তিনি হাসিমুখে করেছেন। বিক্রির জন্যে সমস্ত ভারি গয়না স্বামীর হাতে তুলে দিতে দিতে শেষ সম্বল গিয়ে ঠেকেছিল কয়েকগাছা চুড়ি ও গলার একটিমাত্র চেন-এ।

                         মন তো ভেঙেই গেছে শোকে, ১৮৯৯-এর অভিশপ্ত অগাষ্টে, অত্যধিক পরিশ্রমে শরীর যে ভেঙে পড়ছে টের কি পাননি তিনি? হয়তো নয়? হয়তো একাকীত্বের যন্ত্রণায়, উপেক্ষার নিগূঢ় অপমানে, সন্তাপে সেসব টের পাওয়া-না-পাওয়াকে তিনি ঢেকে দিয়েছিলেন অনুভূতিহীন নিরুত্তাপ অভিমানের কুয়াশায়।

                         তবু শরীর তার নিয়ম মেনে ভেঙে পড়ল আষাঢ় মাসে (১৩০৯) [জুন-জুলাই ১৯০২] মৃত্যুপরবর্তীকালে অবশ্য জগদ্বিখ্যাত স্বামীর স্বীকৃতি জুটেছিল তাঁর কপালে –‘তখন অবশ্য তিনি (মৃণালিনী) ছিলেন। এবং যোগও দিয়েছিলেন আমার কাজে। … তিনি তো চেয়েছিলেন আমার শান্তিনিকেতনের কাজে সঙ্গিনী হবার। … কিন্তু সে তো আর হ’ল না। অল্প পরেই তাঁর সেই ভয়ানক অসুখ হল। … কী দুঃখের সেসব দিন গেছে যখন ছোটোবৌর গহনা পর্যন্ত নিতে হয়েছে। …সম্পূর্ণ নিঃসম্বল হয়েছিলুম … ছোটোবৌকেও অনেক ভার সইতে হয়েছে। জানি সে কথা তিনি মনে করতেন না।’(মংপুতে রবীন্দ্রনাথঃমৈত্রেয়ী দেবী)

µ

                         ‘বোলপুর থেকে কলকাতায় মাকে নিয়ে সেই যে যাওয়া – আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে একটি সামান্য কারণে। মা শুয়ে আছেন। আমি তাঁর পাশে বসে জানলা দিয়ে একদৃষ্টে দেখছি – কত তালগাছের শ্রেণী,কত বুনো খেজুরের ঝোপ, কত বাঁশঝাড়ে ঘেরা গ্রামের পর গ্রাম। কখনো চোখে পড়ল মস্ত বড়ো মহিষের পিঠে নির্ভয়ে বসে আছে এক বাচ্চা ছেলে … একসময় নজরে পড়ল জনশূন্য মাঠের মাঝে ভাঙা-পাড় অর্ধেক বোজা একটি পুকুর – তার যেটুকু জল আছে, ঢেকে গেছে অসংখ্য শাদা পদ্মফুলে। দেখে এত ভালো লাগল, মাকে ডেকে দেখালুম।’(পিতৃস্মৃতিঃ রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

                         ১৯০২ সালের ১২-ই সেপ্টেম্বর হঠাৎ বাড়াবাড়িরকমের অসুস্থ হয়ে পড়া মৃণালিনী দেবীকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। বড় ছেলে রথী সে যাত্রায় ছিলেন মায়ের সঙ্গী। কিন্তু কলকাতায় পৌঁছে রোগের প্রকোপ আরো বেড়ে গেল। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় ‘হতাশ’রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর অসুখ সারাতে হ্যোমিওপ্যাথ ডাক্তারদের ডেকে পাঠালেন। ডাক্তার প্রতাপ মজুমদার, ডাক্তার ডি.এন. রায় প্রমুখের আবার রবীন্দ্রনাথের হ্যোমিওপ্যাথি জ্ঞানে বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। অতএব মৃণালিনীর শিরায়শোণিতে হ্যোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রয়োগে-ও রবি ঠাকুরের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে।

                         আর ভূমিকা ছিল রোগিণীশুশ্রূষার ক্ষেত্রে। প্রায় দুমাসের কিছু বেশী সময় জুড়ে মৃত্যুশয্যায় ছিলেন মৃণালিনী। রবিঠাকুরের অত্যন্ত আদরের ‘ভাই ছুটি’। পুরো সময়টাই রবীন্দ্রনাথ ‘ভাড়াটে শুশ্রূষাকারিণীর’ খাতে পয়সারঅপচয় না করে নিজেই স্ত্রীসেবার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ‘সংসারী রবীন্দ্রনাথ’গ্রন্থে হেমলতা দেবী লিখছেন ‘তখন ইলেকট্রিক ফ্যানের সৃষ্টি হয় নাই দেশে। হাতপাখা হাতে ধরে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পত্নীকে কবি বাতাস দিতেন এক মুহূর্ত হাতের পাখা না ফেলে’। এছাড়াও ছিল ডাক্তারের বাড়ি যাওয়া, ওষুধ খাওয়ানো।

                         অবশ্য হাতের পাখা এক মুহূর্ত-ও কী করে ফেলা গেল না সে সম্বন্ধে খটকা থেকেই যায় কেননা কর্মব্যস্ত রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে মৃত্যুশয্যায় দেখে-ও বর্হিবিশ্বের কোনো কাজেই কোনো খামতি রাখেননি। ব্রহ্মবিদ্যালয় গড়ে তোলার কাজেও কোনো দাঁড়ি পড়েনি কোনোদিন।

                         প্রবল রোগযন্ত্রণা। শরীরে অসম্ভব প্রদাহ। অস্বাভাবিক দুর্বলতা। সারা চৈতন্য জুড়ে আচ্ছন্নভাব। শিয়রে মৃত্যুর অভয়মুদ্রা। এ অবস্থায় যে কোনো মায়ের শেষ ইচ্ছা হবে সন্তানদের কাছে পাওয়ার। একবার তাদের আধোঅচেতনে চোখ মেলে দেখবার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সে পথ-ও বন্ধ করে দিলেন রথীন্দ্রনাথকে আবার শান্তিনিকেতনে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়ে। আট বছরের শমীন্দ্রনাথ আর ন’বছরের মীরা তো বরাবরই ছিল সেখানে। শেষমুহূর্তে ছোট ছেলেকে কাছে পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়েছিলেন। পাননি। ‘সংসারী রবীন্দ্রনাথ’-এ হেমলতা দেবী জানাচ্ছেন “আচ্ছন্ন অবস্থায় কবিপত্নী অনেকবার বলতেন, ‘আমাকে বলেন, ঘুমোও ঘুমোও; শমীকে রেখে এলেন। আমি কি ঘুমতে পারি তাকে ছেড়ে! বোঝেন না সেটা’। এই ‘বোঝেন না সেটা!’-এর ভেতর দিয়েই হয়তো স্বামীর প্রতি তাঁর জীবনে প্রথমবার ও শেষবারের মতো অবরুদ্ধ অনুযোগের ঝাঁঝ বেরিয়ে এসেছিল। হাজার পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও শমীকে আনা হ’ল না। মৃত্যুর-হাত-ধরা নারী আধোআচ্ছন্ন অনুভূতিপ্রদেশ থেকে চোখ ভরে দেখলেন বিখ্যাত স্বামীর এই অতুলনীয় নিষ্ঠুরতা। রোগশয্যায় শুয়ে শুয়েই তিনি পিসিমার সতীন রাজলক্ষী দেবীর ওপর তাঁর সন্তানদের দেখাশুনার ভার দিয়ে গেলেন।

                         মা ভয়ঙ্কর অসুস্থ খবর পেয়ে মজঃফরপুর থেকে সটান কলকাতা চলে এসেছে মাধুরীলতা। এসেছে মীরা, রেণুকা। এসে কী দেখছে তারা? আশ্চর্য হয়ে দেখছে মুমূর্ষ মায়ের পাশে বাবা-ও নেই, দাদা-ও নেই। রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি চিঠি লিখে সে অনুযোগ করেওছে মাধুরীলতা।

                         শুধু তাই নয় পরবর্তীকালে মীরাদেবীর স্মৃতিকথা থেকে আমরা আরো একটি গুরুতর অভিযোগ পাই। যদিও তা তেমন প্রকট নয়। প্রচ্ছন্নই। মীরা লিখছেন ‘মার অসুখ করল, তখন তাঁকে কলকাতায় আনা হল। এখন যেটাকে বিচিত্রা বলা হয় আমরা ঐখানে থাকতুম। তখন আমরা ঐ বাড়িকে হয় লাল বাড়ি নয় নতুন বাড়ি বলে বলতুম। বিচিত্রার লম্বা হল, তাকে তিনটেSwinging partition দিয়ে তিন ভাগ করা ছিল। তারি এক-একটা ঘরে আমরা থাকতুম। সব শেষের পশ্চিমের ঘরে মাকে রাখা হল নিরিবিলি হবে বলে। আমাদের বাড়ির সামনেই গগনদাদাদের বিরাট অট্টালিকা থাকায় নতুন বাড়ির কোনো ঘরে হাওয়া প্রবেশ করত না। তখন বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না। মায়ের অসুস্থ শরীরে ঐরকম হাওয়া-বাতাসহীন ঘরে না জানি কত কষ্ট পেয়েছেন’। তাঁর এ আশঙ্কা হয়তো পুরোপুরি খাটে না কারণ হেমলতা দেবীর বয়ান থেকে আমরা আগেই জেনেছি রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর শিয়রে দিনরাত্রি এক করে দিয়ে হাতপাখার বাতাস করতেন।

                         আশা কিছু ছিল না। জীবনের রোজকার কোলাহল থেকে দিনদিন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিলেন মৃণালিনী, জীবনের এপার-ওপার করার নড়বড়ে কাঠের সাঁকোটা পেরিয়ে গেলেন ২৩-শে নভেম্বর ১৯০২-এ, ১৩০৯ সনের অঘ্রাণের হিম কুয়াশায়। ‘প্রদীপ নিভিয়া গেল’। যার সঙ্গে ‘আজীবন একটা গভীর শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল’ তাকে হারালেন রবীন্দ্রনাথ’।

                         খুব কাছ থেকে সেই চলে যাওয়া দেখলেন বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ। এখানে তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ থেকে একটা অংশ তুলে দিচ্ছি। ‘মৃত্যুর আগের দিন বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপার্শ্বে তাঁর কাছে বসতে বললেন। তখন তাঁর বাক্‌রোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল। মায়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা। আমাদের ভাইবোনদের সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরোনো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন। একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কার মধ্যে আমাদের সারা রাত জেগে কাটল। ভোরবেলায় অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, নিঝুম; কোনো সাড়াশব্দ নেই সেখানে। আমরা তখনই বুঝতে পারলুম আমাদের মা আর নেই। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে’। লালবাড়ি অন্ধকার করে দিয়ে চিরঅচেনার দেশে হারিয়ে গেলেন ভবতারিণী, মৃণালিনী নামের ছদ্মবেশে।

                         ঠাকুর পরিবারের প্রচলিত রীতিকে অস্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ বড় ছেলেকে শবানুগমনে যেতে দিলেন না। মুখাগ্নি করতে দিলেন না। মায়ের পারলৌকিক কাজ থেকে কে জানে কী খেয়ালে প্রথা ভেঙে ছেলেকে বঞ্চিত করলেন। নিজে-ও গেলেন না শ্মশানে। মৃণালিনী একা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে পর একলা উঠে গেলেন ছাদে। নক্ষত্রের আগুনভরা অঘ্রাণের শীতে সারারাত পায়চারি করলেন। পরদিন সকালে শোক সামলে সকলের সঙ্গে শান্তভাবে কথাবার্তা বললেন। শেষে বাড়ি ফাঁকা হলে মৃণালিনীর সবসময়ের ব্যবহারের ‘চটিজুতো জোড়াটি’ রথীর হাতে তুলে দিলেন। শ্রাদ্ধাদির কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন শান্তিনিকেতনে। স্ত্রীবিয়োগের এগারো দিনের মাথায় দীনেশচন্দ্র সেনকে চিঠি লিখে জানালেন ‘ঈশ্বর আমাকে যে শোক দিয়াছেন, … আমি মাথা নীচু করিয়া গ্রহণ করিলাম’। অঘ্রাণে মৃত্যু। সেই অঘ্রাণেই বঙ্গদর্শনে পাঁচটি ‘স্মরণ’ কবিতা ছাপা হ’ল –‘শেষকথা’, ‘প্রার্থনা’, ‘আহ্বান’, ‘পরিচয়’ এবং ‘মিলন’। সমসাময়িক লেখায় পাই মৃণালিনী-বিয়োগের পর রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ নিরামিষ-ভোজী হ’য়ে যান। এমনকি কখনো কখনো শুধু ছোলা ভিজানো, মুগডাল ভিজানো খেয়েও দিন কাটাতেন। মৃণালিনী কি তাঁর মৃত্যু দিয়ে ‘গুরুদেবে’র অহংবোধকে পরাজিত করে গিয়েছিলেন? মৃত্যু মৃণালিণীকে আরো মূল্যবান করে তুলেছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে। প্রতি মুহূর্তে তিনি টের পেতেন ‘এমন কেউ নেই যাকে সব বলা যায়’,অথবা ‘এমন কাউকে পেতে ইচ্ছে করে যাকে সব বলা যায়, সে তো আর যাকে তাকে দিয়ে হয় না’।

µ

 

                         মানুষ মারা গেলে যে আর কোনোদিন ফিরে আসে না এ তো আর কোনো নতুন কথা নয়। কিন্তু মৃণালিনী দিব্যি এসেছিলেন। ৫-ই নভেম্বর ১৯২৯-এ। মৃত্যুর সাতাশ বছর পর। রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি। জোড়াসাঁকোর তেতলার ঘরে। প্ল্যানচেটে।

                         কেমন সব কথাবার্তা হ’ল সে রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, ইহলোক-পরলোকের মধ্যে? অমিতাভ চৌধুরীর ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’ বইতে তার একটা ছবি পাই।

‘প্রশ্নঃ                 কে?

–                        না, বলব না, আমার নাম তুমি বল?

প্রশ্নঃ                  ছোটবৌ নাকি”

–                        হ্যাঁ।

প্রশ্নঃ                  কেমন আছ?

–                        যাদের ভালোবাসি তারা তো একে একে আমার কাছে এল।*

প্রশ্নঃ                  পৃথিবীর সঙ্গে তোমার বন্ধন কি প্রবল আছে?

–                        আছে বৈকি! একথা জিজ্ঞস করো কেন? জানো না কি?

প্রশ্নঃ                  আমার কাজকর্ম, সাধনার প্রতি তোমার interest আছে?

–                        আছে। আমার মন সমস্ত অন্তর থেকে তোমার কল্যাণ কামনা করে।

প্রশ্নঃ                  রথীর কাজে তোমার সম্মতি আছে?

–                        সে কি আমায় জিজ্ঞেস করবার।  তার কাছে যিনি আছেন তিনি দেবতার মতো আলো দেখাবেন’।

                         সঙ্গে ছিলেন না কিন্তু আমৃত্যু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন মৃণালিনী। বাহির-বাড়িতে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে লাখো মানুষের মেলা কিন্তু কবির ভিতর-বাড়ি মৃতা মৃণালিনীর উপস্থিতির নৈঃশব্দ্যে হা হা করত সবসময়।

অন্তত এটুকু বিশ্বাস করতে ভালো লাগে।

============

(‘যাদের ভালোবাসি’ বলতে রবীন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াত তিন সন্তান মাধুরীলতা, রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের কথা বলা হয়েছে।)


ধারাবাহিক উপন্যাস

লোহার

মণিশঙ্কর

অনুকথা

(আট)

   নতুন বৌ নিয়ে গাঁয়ে ফিরছে গঁড়া। পাড়া কাঁপিয়ে বাজছে সাইডড্রাম আর অর্গান। লোহারপাড়ার সব নারী-পুরুষ পথের ধুলো উড়িয়ে নাচছে। নাচছে দিশেহারা মাতাল হয়ে। যাদের একটু কম বয়েস তাদের নাচে সচেতন ফিল্মি কায়দা। আর বয়স্করা এখনও পুরাতনী ঢঙে ছেচতে চাইছে আনন্দ। তাদের মধ্যে যার ফুর্তি গায়ে ধরছে না, সে হল সাগরা। বেঢপ চেহারার অতিরিক্ত মাংসস্তূপকে নিয়ে যে কী করবে তার যুতসই তালটি যেন খুঁজে পাচ্ছে না। এগচ্ছে। পিছোচ্ছে। হেলছে। দুলছে। হাতে তালি দিচ্ছে। ঝাঁপানোর চেষ্টা করছে কিন্তু টাল খেয়ে পড়ছে পাশের জনের গায়ে। অমনি হেসে উঠছে হিলহিল করে। আবার দাঁড়াচ্ছে। ডানহাতখানা উঁচিয়ে হেঁকে উঠছে পাল্লার গান,

“বলি মন দিলি পাগল কইরে

কী কইরে মন

মাইরি কী কইরে মন থিনাব ঘরে লো

কী কইরে মন– হে-ই-ই-ই-ই–”

   কিন্তু তার এ গান না যাচ্ছে সাইডড্রামের তালে আর না লাগছে অর্গানের সুরে। তাই নিজের মুখেই হেঁকে উঠেছে মাদলের বোল, “ধা– তাক-তাক-তাক– ধাতিং– উরররররররর– ধাতিং– তিং-ধাতিং– তাগদা-ধাতিং– ধাধাগ ধাতিং– তিং-ধাতিং– হা-হা-হা–”

   আবার হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। তার ফাঁকেই সাগরার চোখ পড়ল জনকের উপর। দলটার পাশেপাশে শান্তভাবে হেঁটে চলেছে। সাগরা তার আমড়া আঁটির মতো চোখজোড়ায় কৌতুক নাচিয়ে ছুটে গেল জনকের কাছে। হাত বাড়িয়ে গেয়ে উঠল,

“অ হ্যা সাঙ্গাৎ আমার লোক ভাল

তার অ্যামন মনে

বলে অ্যামন মনে ক্যা দাগা দিল লো

অ্যামন মনে– হে-ই-ই-ই-ই–”

তারপরই ধরে ফেলল জনকের একটা হাতে। টান দিল তাতে। বলল, “আইস হ্যা সাঙ্গাৎ! একটুকুন লাইচে লিবে। আইস আইস। দ্যাখ দেখি সুবায়ের মনে ক্যামনপারা রঙ লাগিচে আজকে!”

   “না-না, আমার উসোব লাচফাচ হবেক্ নাই। তুঁই লাইচ্চিস্, তুঁইয়েই লাইচে মরগা যাঁইয়ে।”

   “লাইচব নাই বইল্লে ত শুইনব নাই সাঙ্গাৎ! আইজকের পারা অ্যামন ফুর্তির দিনে তুমার পারা হাউস্যা লোক অ্যাকটুকু লাচ কইরবে নাই? ই আবার কখনু হয় নাকি! আইস আইস ত, লাইচবে আইস।”

   “ছাড়। ছাড় বলচি হাতটাকে। নাইলে মাইরব শালার পঁদে এক গঁড়ার।” মারবো বলেও সাগরার পাছায় একটা লাথি বসিয়ে দিল জনক। সাগরা পাছায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “আঃ, একটুকুন আস্তে মাইরবে ত!” তারপরই আবার ছলকে উঠল, “অ, লাইচবে নাই? থাইলে লাইচ নাই।” নিজে ফিরে গেল দলটার মাঝে। হাঁপাতে হাঁপাতে একইভাবে হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল,

“বলে তুদের জামাই রাইতকানা লো রাইতকানা

অড়হর বাড়ির

মাইরি অড়হর বাড়ির খোঁচা মানে না লো

অড়হর বাড়ির– হে-হে-হে-হে

মন রে পান(প্রাণ) আমার স্যারে-রে-রে

আয় বিজলি কোলে তুলি হাঁ দ্যাখ হাঁ দ্যাখ…”

   সাগরার ফূর্তি দেখে একচিলতে হাসল জনক। আপনমনেই বিড়বিড় করল, “অ্যাঃ, একবারেই মাতাল ব্যাহেড হঁইয়ে গেইচে! লাজলজ্জ্যারঅ মাথা খাঁইচে। মরগ্যা যা শালা, আমার আর কীট্যা!”

   কিন্তু তার বিড়বিড়ানি সাগরার কানে পৌঁছাল না। সকলের সঙ্গে সে চেটেপুটে নিতে চাইল আনন্দের সবটুকু হুল্লোড়। যেমন চাইছে লোহার পাড়ার অন্যরা। মনে যার যাই থাকুক, এই আনন্দে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে সকলেই। দেয়নি শুধু একঘর। দলটা সেই ঘরটার কাছে আসতেই থমকে দাঁড়াল সাগরা। কোমরের গামছা খুলে মুছে নিল মুখের ঘাম। বুকের সামনে বাঁইবাঁই করে ঘোরাতে লাগল গামছাটা। মুখে এমন ভাব নিয়ে এল যেন সারা পথ নেচে সে বড়ো ক্লান্ত। দলটা তার এ ভাবভঙ্গী গেরাহ্যই করল না। এগিয়ে গেল কুলি বেয়ে। অমনি সাগরা টুক করে ঢুকে পড়ল নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা ঘরটার উঠোনে। হাঁক পাড়ল, “কই গ বালিবৌ! কুথাকে গেলে? একটুকু বেরাঁই আস ক্যানে!”

   “ই বাবা! সাগরা ছঁড়া না ক্যা বটিস্ রে?” ঘর থেকে একজন পড়ন্তযৌবনা মহিলা বেরিয়ে এল। বলল, “তা ধুমড়ি লাচ ছাইড়ে আমাদের ঘরে কীট্যা বটে তুর? আয়। বোস।”

   “দাও, একঘঁটি জল দাও ত। বাবা রি, ছেল্যাছুকরাদের সঙে লাইচে লাইচে পেরাণটা বেরাঁই গেলেক্ গ! আমি কি আর অত পারি!”

   “ত লারিস্ যখন তখন অত কইরে লাইচতে যাওয়ার দুরকার কিট্যা তুর?” বালি উঠে গেল জল আনতে। আর সাগরার চোখজোড়া টলটল করে উঠল কুচল্যা ফলের মতো। বলল, “ই তুমি কী বইলচ গ বালিবৌ! ছেলাতে ঘরকে বৌ আনলেক্ আর আমি একটুকুন ফুর্তি কইরব নাই! তাই আবার হয় নাকি গ!”

   “হয় নাই যখন তখন আবার হেঁসুরে মইচ্চিস্ ক্যানে রে ছঁড়া? হাঁই ল্যা, ধর।” বালি একঘটি জল বাড়িয়ে দিল সাগরার দিকে। সাগরা বালির কথার কোনো উত্তর দিল না। বলল, “হঁ-হঁ, দাও দাও।”

   “দিঁইয়ে পদে হ্যাঁ রে ছঁড়া, ছেল্যাতে আমাদের ক্যামন পারা বৌ আনলেক্ ঘরকে?”

   “ভাল, খুবেই ভাল বটে।” সবটুকু জল একনিশ্বাসে শেষ করে সাগরা খালি ঘটিটা এগিয়ে দিল বালির দিকে। বলল, “য্যামন পারা চোখ-মু তেমনি পারা হাতপায়ের গড়ন। আর রঙটিঅ ব্যাশ মধুশ্যামলা। বুজলে! গাইদে মিঠা মেইয়্যা বটে গ বালি বৌ। গাইদে মিঠা মেইয়্যাকেই পালেক আমাদের গঁড়া। তবে–”

   “তবে? তবে আবার কী বটে রে ছঁড়া? দোষের কিছু বটে নাকি?”

   “হঁ, স্যা একরকম দোষেরেই বটে। তবে ইট্যা উয়াদের কনু দোষের লয়।”

   “থাইলে কাদের দোষ বটে শুনি?”

   “কিছু মনে লিঅ নাই বালিবৌ। ইট্যা তুমাদেরেই দোষ বটে।” বালির মুখ থেকে দৃষ্টি গুটিয়ে নিল সাগরা। নিজের আঙ্গুলগুলো দেখতে থাকল আগ্রহভরে। অমনি খেঁকিয়ে উঠল বালি, “কী! আমাদের দোষ? আমরা আবার কাদের বাড়াভাতে পঁদপাতে হাগতে গেলম শুনি?”

   “না-না, হাগতে যাবে ক্যানে বালিবৌ! হাগতে যাবে ক্যানে!” আমতা আমতা করে নিজেকে শুধরে নিতে চাইল সাগরা। বলল, “কারু কনু অলিষ্ট খুঁজবার পারা লোক তুমি লও। স্যা আমিঅ জানি। তবে একবার ভাইবে দ্যাখ বালিবৌ, সারা নুয়ারপাড়া বিয়াতে গেলেক্, আর ভাই-ভায়াদ হঁইয়ে উ ঘরের বাদাড় পেরালে তুমরা মায়ে-ছাঁয়ে। ইট্যা কি কনু ভাল কাজ হলেক্? বল ক্যানে! তুমিয়েই বল!”

   গতকাল থেকে বালির নিজের মনেও এই প্রশ্নটাই খচখচ করেছে। এখন সেটাই সাগরার মুখ থেকে শুনে খেঁকিয়ে উঠল, “অ, তাল্লাগেই ভালমানিষটি সাইজে তুঁই ভাই-ভায়াদের হঁইয়ে গণ্ডুগুল লাইগতে আসিচিস্ নাকি?”

   “না-না, গণ্ডুগুল লাইগতে আইসব ক্যানে বালিবৌ, গণ্ডুগুল লাগতে আইসব ক্যানে! স্যা আমি আসি নাই।”

   “হঁ রে হঁ ছঁড়া! আমি কিছু বুজি নাই লায়।” একবার ঝট করে পাশের ঘরটার দিকে তাকিয়ে নিল বালি। তারপর গলা নামিয়ে বলল, “ইয়াকে গণ্ডুগুল লাগা বলে নাই ত আর কী বলে শুনি? ছেল্যাতে মাইনলেক্ নাই কিছুতেই। মান কইরে বইল্লেক্, ‘যদি তুঁই যাস্ ত আজকেই আমি ঘর ছাড়ে পালাব।’ থাইলে ক্যামন কইরে যাই! ছেল্যা আগে, না ভাই-ভায়াদ আগে শুনি? বলে, কতদিন বাদে ছেল্যাতে আমার ঘরমুয়্যা হঁইচে!”

   “ছেল্যাতে মাইনলেক্ নাই! আর তুমি সেইট্যাই মাইনে লিলে! ক্যানে, ছেল্যাকে বুজাঁই বইলতে লাইল্লে, ভাই-ভায়াদের সঙে অমন কইরে বিবাদ কইত্তে নাই? আর ই কুথাটা আমি উদামাদা লোক হঁইয়ে বুজতে পারি, আর স্যা লাইল্লেক্! থাইলে কী নিকাপুড়াটা শিখলেক্! শুনি ত গাইদে নিকাপুড়া করিচে! এই উয়ার নিকাপুড়া! ই বাবা! অতদিন ধইরে চইলে আসা সোবকে বলচে একফুঁকেই উড়াঁই দুব গ!”

   বিস্ফারিত চোখ নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল সাগরা। বালিও আর সংযত রাখতে পারল না নিজের গলা। তারস্বরে চেঁচিয়ে বলল, “হঁ-হঁ, তাল্লাগেই ত তারা তুখে পাঠাঁইচে তাদের হঁইয়ে গণ্ডুগুল লাইগতে। ক্যানে রে? বলি ক্যানে শুনি? উয়ারাও কি একবার আইসে ডাকে লিঁইয়ে যাইতে লাইল্লেক্! ক্যানে, উয়াদের যদি মনের গুমারে ভুঁইয়ে পা না পড়ে, থাইলে আমাদেরেইবা দায়ট্যা কীসের বটে শুনি?”

   সাগরা বালির মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেল। ভালো চেয়েই সে এসেছিল। ভেবেছিল, সে একবার বলে গেলে যদি দু’ঘরের ঝামেলা মিটে যায় তো যাক। কিন্তু বালির রণচণ্ডীমূর্তি দেখে থমকে গেল সে। পিছন দিকে একটু হেলেও গেল ভয়ে। ছেলেমানুষের মতো গাল ফুলিয়ে বলল, “আমি ত তুমাদের ভালর লাগেই আলম। আর তুমি–”

   “ভালর লাইগে! ইয়াকে ভালর লাগে বলে? আমি কিছু বুজি নাই লায়? তুঁই কী মনে লিস্, কার কুথাতে তুঁই লাচ্চিস্, স্যা আমি জানি নাই? মাগে তাড়ান লিমদ্যা কুথাকার! দুব অ্যাখনেই ঘঁটিটা দিঁইয়ে ঠুকে তুর মু’ট্যাকে ভাঙে। উঁ! ভালমারান্যা ভালমারাতে আসিচে! বের‍্যা বলচি ইখ্যান ছাইড়ে।”

   সত্যিই ঘঁটি তুলে তেড়ে গেল বালি। ঝট করে উঠে দাঁড়াল সাগরা। কোনো দিকে না তাকিয়ে লদপদ করে দৌড় লাগাল বাদাড়ের দিকে। অমনি হুস করে বালির মনটা দমে গেল। তাকাল টিনের চালাটার দিকে। সেখানেই বিকাশ সকাল থেকে ঢুকে আছে। বালি একটুক্ষণ ভাবল। তারপর ধীরে ধীরে চালাটার কাছে এল। আবার ভাবল একটু। উদ্গত দীর্ঘশ্বাসটা চাপল। তারপর উঠে এল দাওয়ায়। ঘরে ঢুকে দাঁড়াল চৌকাঠে হেলান দিয়ে। বলল, “কী রে, ই সুকাল বেলাতেই শিযে গড়াগড়ি দিচ্চিস্ য্যা! বলি শরীল-টরীল খারাপ বটে নাকি?”

   “না।”

   “না ত ই সাতসুকালবেলাতে গড়াচ্চিস্ ক্যানে?”

   “উ কিছুয়েই লয়। এমনি।”

   “কিছু বটে, না না বটে স্যা তুঁইয়েই জানিস্!” গলাটা একটু নরম হল বালির। যেন আরও কিছু বলতে চায় এমন ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু বলার মতো সাহস জুটাতে পারল না। বিকাশও কিছু জিজ্ঞাসা করল না। একভাবে পড়ে থাকল লিয়াল দড়ির খাটিয়ায়। দায়ে পড়েই বালি বলল, “বলছিলম– বলি, কিছু কি কানে সিমাচ্চে না নাই? সোব সোময়ে বইমুয়্যা হঁইয়ে ত নাইলে গাইদে দিগ্গজ হচ্চিস্!”

   “হঁ, শুনচি। বল ক্যানে কী বটে?”

   “বলছিলম, উ ঘরে ত সোব বৌ লিঁইয়ে ঘুল্লেক্ মনে লেয়!”

   “হঁ।”

   “হঁট্যা কী? বলি, হঁট্যা কী বটে শুনি! একবারঅ যাইতে হবেক্ নাই নাকি? এমনি করেই ভাই-ভায়াদ সোব ছাড়া করবি!”

   সাগরার সঙ্গে কথা বলার সময়ের ঝাঁজ ফিরে এল বালির। সঙ্গে সঙ্গে বোঁ করে মাথা ঘোরাল বিকাশ। চেঁচিয়ে উঠল বালিও, “হাঁ ভাল, চোখ দেখাস্ নাই বুজলি! চোখ দেখাস্ নাই। তুর উ চোখকে আমি অত ডরাই নাই। ভাই-ভায়াদের বিপার বটে! বিয়াতে না যাইতে দিলি, না দিলি। তাবইলে ঘরকে লতুন বৌ আলেক্, পাঁচট্যা কুটুম আলেক্, ত সেখ্যানকে একবারঅ যদি খবর-অবর লিতে না যাই, ত পাড়ার পাঁচট্যা লোকেইবা কী বইলবেক্ আর লতুন কুটুমরাইবা কী ভাইবেক্?”

   “অ! স্যা ব্যাটা খ্যাপা মাতালটা আইসে ই সোব মন্তরেই তুর কানে দিঁইয়ে গেলেক্ লায়?”

   “মন্তর দিতে ক্যানে হবেক্? বলি মন্তর দিতে ক্যানে হবেক্ শুনি! উ কি কনু খারাপ কুথা বইলিচে?”

   “না, খারাপ কী লাইচতে হবেক্! তুর মনঅ য্যা ছটছটি দিচ্চে অই ধুড়ুক লাচনে যোগ দিতে, সেইট্যা আমি বুজতে লাচ্চি ভাবিচিস্?”

   “তা লাইরবি আবার! তা ত পারবিয়েই। ভাল কুথাই বটে। তুর যা মনে লেয় তুঁই তাই ভাব। আমি আপনার চল্লম।” ঘুরে পা বাড়াতে গেল বালি। অমনি চেঁচিয়ে উঠল বিকাশ, “যা না, যা। যাঁইয়েই দ্যাখ একবার। তাবাদে জিঠ্যা যদি বাখানে গুষ্টীশুদ্দা উদ্ধার না কইরে ছাড়ে ত আমার নামেই বিকাশ্যা লয়।”

   “করুক্ বাখান। তবুঅ ত পাড়ার কেউ আমাদেরকে দুষতে লাইরবেক্। আমি আপনার চল্লম।” বালি আবার পা বাড়াতে গেল। চেঁচিয়ে উঠল বিকাশ, “খবদ্দার বইলচি মা! এক পা’অ বাড়াবি নাই।”

   “বাড়াইলে কী কইরবি কীট্যা শুনি? মাইরবি? ল্যা মার না, মার।” বালির দু’চোখ ছলছল করে এল। কাপড়ের খুঁটে সেটা মুছে ভাঙাগলায় বলল, “এই নাইলে ব্যাটা রে! উঃ, জিউট্যা জ্বালাঁই ছাড়লি তুঁই! বলে, লোকের ব্যাটাতে জুয়ান হইলে কত আসান হয়। আর তুঁই? আসান কইরবি কী, ই বুড়াকালে ভাই-ভায়াদ ছাড়া করালি। ইয়ার লাগে কি তুখে প্যাটে ধইরেছিলম রে আমি?”

   হড়বড় করে বেরিয়ে যেতে গেল বালি। বিকাশ ঝট করে উঠে বসল। বলল, “দাঁড়া। যাস্ নাই। আগে আমার কুথাটা শুন।”

   বালির দুই ভ্রূকুঁচকে এল। সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল বিকাশের দিকে। বিকাশ মাথাটা বারদুই এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বলল, “দ্যাখ্ মা, আমিঅ জানি, একবার না গেলে বিপারট্যা খারাপেই দ্যাখাবেক্। তবে তুঁই য্যা আগ বাড়াঁই যাবি, দিঁইয়ে পদে যদি আবার– মানে, জিঠার যা বাখান্যা মু! তার থাইকে দাঁড়া। আমিয়েই আগে ঘুরে আসি। তাবাদে তুঁই– না কী বলিস্?”

   “তুঁই যাবি!” উজ্জ্বল হয়ে উঠল বালির সারামুখ। বলল, “তাই যা বাপ, তাই যা। তবু যদি তুর জিঠ্যার রাগ খ্যানেকট্যা পড়ে!”

   “আমি জিঠ্যার লাইগে যাতে খুঁজি নাই মা। আমি ভাইবচি, লতুন বৌয়ের ত আর কনু দোষ নাই। না গেলে পদে উয়েবা কী ভাইবেক্!”

   “হঁ, স্যা ত বটেই। থাইলে তাই যা বাপ। লতুন বৌয়ের সঙে টুগদু ভাব-সাব কইরে আয়। আমি তখনকে হাতের কাজগুলান বাগাঁই লিই।” বুকের কাপড়টা একটুখানি ডান দিকে টেনে নিল বালি। পা বাড়াল উঠোনের দিকে। বিকাশ আপন মনেই বিড়বিড় করল, “সেই ভাল। আমিয়েই যাই।”

   ঝাটপট লুঙ্গিটা বদলে পা বাড়াল বাইরের দিকে।

   এদিকে গুইরামের উঠোনে বাজনা থেমে গেছে। পুরুষরা শরীর এলিয়ে দিয়েছে এখানে-সেখানে। কেউবা বিড়ি ধরিয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট টান দিচ্ছে তাতে।

   নতুন বৌকে ঘিরে জমে উঠেছে ভিড়। মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাকে ঘরে তুলতে। তার মধ্যে এক ফোকলামাড়ির বুড়ি সকলকে ঠ্যালাঠেলি করে বলল, “দেখি লো, একটুকুন সের‍্যা ক্যানে! তুদের লৈতন বৌয়ের মু’ট্যা একটুকুন দেখি।”

   সামনে এসে নতুন বৌ আহ্লাদীর চিবুক তুলে ধরল বুড়ি। গুইরামের মেয়ে ক্ষেমী হাসিমুখে বলল, “অ্যা বৌ, ই তুর দিদিম্যা বটে লো!”

   বুড়ির মুখে আচমকা কৌতুক ছলকে উঠল। ঘাড় দুলিয়ে গেয়ে উঠল পাল্লার গান,

“বলি, রূপ দেখে আমি যাই মইরে

অ্যামন আগুন

অ্যামন আগুন রাইখব কন ঘরে লো

মাইরি অ্যামন আগুন।।”

   “অ্যা হ্যা-অ্যা-অ্যা-অ্যা-অ্যা– দিদিম্যা, কী দিলি লো!” আহ্লাদীকে ঘিরেথাকা ভিড়টা ফেটে পড়ল উল্লাসে। কোথা থেকে ছুটে এল সাগরা। বগল বাজিয়ে নাচতে লাগল সে। মুখে শুরু করে দিল মাদলে বোল, ““ধা– তাক-তাক-তাক– ধাতিং– উরররররররর– ধাতিং– তিং-ধাতিং– তাগদা-ধাতিং– ধাধাগ ধাতিং– তিং-ধাতিং– হা-হা-হা– দ্যা-দ্যা বুড়ি! ঠাঁইসে দ্যা। গাইদে দ্যা!”

   “শুদুমুদু আমি দিলেই ত হবেক্ নাই রে ছঁড়া! তুদের লতুন বৌকে ইয়ার কাটান দিতে হবেক্ য্যা!”

   পাল্লার গানের নিয়মই এই। একজন গান ধরলে আরেকজনকে দিতে হয় কাটান। তার কাটানের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমজন দেয় তার পাল্লা। এভাবেই নাটকীয় সংলাপে জমে ওঠে পাল্লার গান। যখনই কোনো একজন গেয়ে ওঠে,

“মন রে পান(প্রাণ) আমার স্যারে রে-রে

আয় বিজলি কোলে তুলি হাঁ দ্যাখ হাঁ দ্যাখ…”

তখনই বুঝতে হবে সে পাল্লায় হার স্বীকার করল। তখন অন্য কেউ এগিয়ে আসে পাল্লা দিতে। এখন বুড়ি সেই কাটান দেওয়ারই ইঙ্গিত দিল। সঙ্গে সঙ্গে ভিড়টা সরব হয়ে উঠল, “হঁ-হঁ, কাটান দিতে হবেক্, কাটান দিতে হবেক্!”

   তাতেই রাঙা হয়ে উঠল আহ্লাদীর মুখ। চিবুকটা ঝুঁকে পড়তে চাইল বুকে। বুড়ি কুঁচকানো চামড়ার মাঝে চোখের তারায় ঝিলিক নাচিয়ে বলল, “কই লো, তুদের বৌ কঁকা বটে নাকি? কনু রা বের‍্যাচ্চে নাই য্যা!”

   ভিড়টা খিলখিলিয়ে উঠল হাসিতে। পাশের চ্যাংড়া গোছের একটা মেয়ে আহ্লাদীর পিঠে কুনুয়ের গুঁতো মারল একটা। বলল, “মু খুল বৌ, মু খুল। আমাদের বুড়্যাদিদির বুড়াকালে আবার রস গড়্যাঁইচে– হি-হি-হি।”

   “ই মা লো!” বুড়ি অবাক হওয়ার ভান করে তার তপড়া গালে হাত ছোঁয়াল। বলল, “ই কি সত্যি সত্যিই কঁকা বটে না কী লো!” অমনি ঘাড় সোজা করল আহ্লাদী। তীক্ষ্ণচোখের খরদৃষ্টি ফেলল বুড়ির মুখে। বুড়ির কুঁচকানো চামড়ায় কিলবিল করে উঠল কতকগুলো ভাঙাচুরো রেখা। বলল, “বাবা! ই য্যা খরিস্ সাপের পারা ফুঁইসে উটচে লো! বলি কামড়াঁই-ফামড়াঁই দিবেক্ নাকি!” তারপরই বাঁহাতটা কোমরে আর ডান হাতের উল্টোপিঠটা মাথায় দিয়ে নেচে উঠল,

“ভাই লো আমার কল্লি কী

কঁকা দেখে

বলি কঁকা দেখে সতীন জুটালি লো

কঁকা দেখে।।”

   “হৈ-ঐ-ঐ-ঐ-ঐ-ঐ-ঐ-ঐ–” ভিড়ের মাঝে কয়েকটা চ্যাংড়া ছোকরা সিটি দিয়ে উঠল। সাগরাও হেঁকে উঠল মাদলের বোল, “ধা– তাক-তাক-তাক– ধাতিং– উরররররররর– ধাতিং– তিং-ধাতিং– তাগদা-ধাতিং– ধাধাগ ধাতিং– তিং-ধাতিং– হা-হা-হা–”

   এবার ফিক করে হেসে ফেলল আহ্লাদী। বুড়ি নাচ থামিয়ে বলল, “এই য বুনের আমার হাঁসি বেরাঁইচে! কিন্তুক্ উ হাঁসি দেখে ত আমি ভুইলব নাই বুন। গায়েন কুথায়? কাটান য্যা তুখে দিতেই হবেক্! নাইলে য্যা লোকে তুখে কঁকা বইলবেক্ লো! গা বুন, গা।”

   “কঁকা বইল্লেই হলেক্! কঁকা হতে যাবেক্ ক্যানে লো দিদিম্যা? লতুন বৌ গলা ফাইড়্যা গায়েন হাঁকাবেক্! তাই কখনু পারে! তুঁইয়েই নাকি পারিছিলি?”

   “আঃ, তুঁই থাম লো ক্ষেমী। লতুন বৌ লাইরবেক্ ত কি উয়ার বাপের ঘরের থাইকে কেউ আসে নাই নাকি? তারা সোব কন খালকে মইত্তে গেলেক্?”

   “মইত্তে যাবেক্ক ক্যানে লো! কাল রাত থাকে ত কম খাটালি হয় নাই সুবায়ের! তাথেই–”

   “আঃ, বলে যার মাগ তার সুয়াগ নাই/ হাঁ পাড়ার লোকের মু শুকাঁইয়ে যায়। অ লো, আমাদেরঅ এককাল গেইচে লো, আমাদেরঅ এককাল গেইচে। কই আমরা ত খাইটে মরি নাই। ছেল্যার বিয়া হলেক্, ত টুগদু হাসিমজাক্ হবেক্ নাই? ক্যানে, বৌয়ের বাপের ঘরের লোকের কি মুয়ে পুকা পড়িচে নাকি?”

   “বলি, শুন গ বড় কুটুম!” এতক্ষণ আহ্লাদীর দিদিমা চুপ করেই ছিল। কিন্তু আর পারল না। কাপড়ের আঁচলটা কোমরে জড়াতে জড়াতে এগিয়ে এল। অমনি আহ্লাদী ধরে ফেলল তার হাতটা। বুড়ি একঝটকায় সেটা ছাড়িয়ে নিল। বলল, “দাঁড়া লো তুঁই। উয়ারা আমাদের লিঁইয়ে গালমন্দ কইরবেক্ আর আমি মু নামায়ে কুটুম্মিত্যা কইরব! স্যা হবেক্ নাই।”

তারপর বুড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “হঁ গ বড় কুটুম, শুন, বলি লৈতন কুটুম বলে চুপ দিঁইয়ে থাকা। নাইলে আমার মরদঅ কিছু কম ছিলেক্ নাই। দু’দশটা গাঁকে পাল্লাতে জল খাওয়াতে পাত্থক স্যা, তা মনে রাইখবে।”

   “ত, অতই যদি পঁদে রস থাইলে কাটান না দিঁইয়ে অতক্ষণ পুকামুয়ে চুপ মার‍্যা ছিলি ক্যানে লো। অ লো ভাইভাতারি! তুঁই দ্যা কাটান। আমিঅ দেখি তুর মুরাদ কত!”

   “ব্যাশ, দ্যাখ তবে।” বুড়ির মুখোমুখি চলে এল আহ্লাদীর দিদিমা। বুড়ির মতোই নাচতে নাচতে গাইল,

“বলি লাগিনি লাইগে যাব

শিঁয়াকুলে

শিঁয়াকুলে বাদাড়ে দুব লো

শিঁয়াকুলে…”

বুড়ি গাইল,

“বলি, পাল্লা দ্যা পাল্লা দুব

তুখে হারাঁই

তুখে হারাঁই তবে জল খাব লো

মাইরি তুখে হারাঁই…”

   “অ্যা, সের‍্যাও গ সোব, সের‍্যাও। লতুন বৌকে একটুকুন দেখতে দাও।” হঠাৎ ভিড় ঠেলে সামনে এল বিকাশ। বুড়িকেই বলল, “তুর লোতুন লাতবৌ দেখতে আলম গ দিদিম্যা। বলি, মু থাইকে কাপড়টা একটুকুন সের করাঁই দাও ক্যানে। দেখি, আমাদের গঁড়া দাদা কেমন পারা বৌ আনলেক্ ঘরকে!”

   “আস দাদা! আস।” ক্ষেমী হাসিমুখেই বিকাশকে আহ্বান জানাল। একটু অনুযোগের সুরে বলল, “কাইলকে তুমরা কেউ আলে নাই য্যা?”

   “বলে, বিয়ান বেলায় তুঁই লাগরের দেখা নাই/মিন সোময়ে লিমুস্ক্যা করে আইঢাই।” জমে ওঠা কৌতুকে বাধা পড়ায় বুড়ি তিরক্ষি হয়ে উঠল। শোলক কেটে বলল, “দ্যা লো খ্যামী, দ্যা। বৌ-এর মু থাইকে কাপড়টা টুগদু তুইলে দ্যা।”

   তার শোলকের খোঁচা বিকাশকে আহত করল। মুখের রেখারা শক্ত হয়ে উঠতে চাইল। কিন্তু তাকে জোর করে শান্তও করল। বদলে একচিলতে হাসির রঙ জাগাল ঠোঁটে। গলায় রসিকতা ছলকে আহ্লাদীর উদ্দেশ্যে বলল, “শুন গ লোতুন বৌ! তুমি সম্পক্কে আমার বৌদিদিই বট। আর আমি হলম তুমার দেয়র। তবে যা শুনেচি তাথে তুমি আমার থাইকে অ্যানেকটা ছুটুই বট। তাথেই ভাইবছিলম, তুমাকে কী বইলে ডাইকব। শুদু বৌদিদি বলতেও কেমন পারা লাইগচে!”

   উপর দিকে মুখ করে ভাবতে শুরু করল বিকাশ। হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভাবে ছলকে উঠল। বলল, “আচ্ছা, যদি রাঙাফুল বলি?”

   আহ্লাদী এর কোনো উত্তর দিল না। ঘাড়টা গুঁজে নিল একটুখানি। বিকাশ সামনের দিকে খানিক ঝুঁকল। আবার একটা খোঁচা দিল, “কী গ রাঙাফুল! কুথার জুবাব দিছ নাই য্যা? পাতান সম্পক্কটা কি তুমার পছিন্দ হলেক্ নাই নাকি?”

   চকিতে মুখ তুলল আহ্লাদী। ফিক করে হেসেও ফেলল আবার। বিকাশ দেখল, তিরতির করে কাঁপছে পুরুষ্টু অধর। ফুলেফুলে উঠছে ঘাম চিকচিকে নাকের পাটা। বিকাশের বইপড়া মন স্বগতোক্তি করল, “বাঃ! অপূর্ব!”

   কিন্তু ভ্রূ দু’টো কুঁচকে উঠল আহ্লাদীর। তা দেখে বিকাশ নিজেকে সামলে নিল। বলল, “অ্যাঃ, তাথেই ত ডাকেচি রাঙাফুল বইলে! দ্যাখ দেখি ক্যামন রাঙা পারা মু’টি! না গ দিদিম্যা, গঁড়াদাদার পছিন্দ আছে মাইনতে হবেক্। খুঁজেপাইতে ক্যামন সরেস পারাটি আনিচে দেখিচ?”

   “দেখিস্ ভাই, রূপ দেখেই তুর যা হাল, আবার পিরিত কইরে কুলে কালি দিয়াস্ নাই!”

   “ধুর, তুমি যে কী বল নাই দিদিম্যা! আমি–”

   “তুখে আর দিল্লাগি মারাতে হবেক্ নাই রে ব!” বিকাশের কথা শেষ হওয়ার সুযোগ পেল না। তার আগেই টলমলানো শরীরে ভিড়ের মাঝে এসে দাঁড়াল গুইরাম। নেশাজড়ানো গলায় একটা হেঁচকি তুলল। বলল, “আমাদের পারা ছুটুলোকের বিয়াতে যাইতে যখন তুর মানে লাগিচে তখন আর বৌয়ের সঙে দিল্লাগি ক্যানে বাপ! যা, নিকাপুড়াকরা বাবুছেল্যা আমার, ঘরের ছাঁ আপন ঘরকে যা।”

   মুহূর্তের মধ্যে মুখের নরম রেখারা সব উধাও হয়ে গেল বিকাশের। সকলের দিকে একবার চট করে চোখ বুলিয়ে নিল। বিদ্রোহী রেখাদের সংযত হওয়ার সুযোগ দিল। একটা ঢোক গিলে বলল, “জিঠ্যা, ই তুমি কী বইলচ! ঘরকে লোতুন বৌ আল, আর আমি–”

   “অ্যাঁ– কী আমার বৌ-মারান্যা ছাঁ রে ব! থাক, তুখে আর দরদ দেখাতে হবেক্ নাই। অ্যানেক করিচিস্। ই বিয়া লিঁইয়ে তুঁই যা কইরেচিস্, যদি আমি কালিন্দ্যা নুয়ারের ব্যাটা হই ত জেবন থাকতে ভুইলব নাই। অ্যাখন যা দেখি ইখ্যান থাইকে। তুর উ মু’ট্যা দেখলে আমার পঁদের ট্যানাটাতক্ক জ্বইলে যেছে।”

   এর উত্তরে কী যে বলা যায় তাই বুঝে উঠতে পারল না বিকাশ। মাথানামিয়ে ঘুরল সেখান থেকে। গুইরাম হাঁক পাড়াল, “হঁ-হঁ, যা। আর কখনু উ মু লিঁইয়ে আমাদের ঘরের দিগে ভালিস্ নাই বইলে দিলম। নাইলে তুর নিকাপুড়া করা উ দিমাকি চোখ দু’ট্যাকে আমি গালে দুব, ইট্যা মনে রাখবি।”  

   হঠাৎ থমকে দাঁড়াল বিকাশ। চোখমুখ লাল হয়ে উঠল তার। ফিরে তাকাল গুইরামের দিকে। গুইরামও টলমলানো শরীরটা নিয়ে এগিয় গেল। বিকাশের বুকে সজোরে একটা ধাক্কা দিল। বলল, “চোখ কাখে দিখাচ্চিস্ রে ব তুঁই, আঁ? তুঁই চোখ কাখে দিখাচ্চিস্?”

   এই সময় কোথা থেকে ছুটে এল জনক। গুইরামের কোমরটা ধরে ফেলল সে। বলল, “অ্যা দাদা, কী কচ্চিস্ কী? কাজের ঘরকে আসা কাখুকে ই রকম কইরে মাইর-ধইর কইত্তে আছে?”

   “ছাড় আমাকে। ছাড়ে দ্যা বলচি জনক্যা। চাঁদির ছাঁকে আমি আজকে একহাত দেখেই লুব। ছাড়।”

   “আঃ, থাম। যতই হোক, আজ উ তুর ঘরকে আসিচে। নুয়ারসুমাজে কাজের ঘরকে আসা মানুষকে খেদে দিয়া কনু লিয়ম লয়। তবু যদি তুঁই মারপিট কইরবি থাইলে আমিঅ ছাড়্যা কুথা বইলব নাই, ই আমি বলে দিচ্চি।”

   জনক আরও জোরে কষে ধরল গুইরামের কোমর। গুইরাম প্রথমটা ঝাঁকাঝাঁকি করে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু সামর্থে কুলোল না। তাই সজোরে কামড়ে ধরল জনকের বাহু। অমনি জনক আর্ত চিৎকার করে উঠল, “আঃ!”

   তারপরই দপ করে আগুন জ্বলে উঠল মাথায়। গুইরামকে সজোরে ছুঁড়ে দিল পাশের দিকে। গুইরাম ছাঁচকোলে পড়ল মুখগুঁজে। গঁ-গঁ শব্দের সঙ্গে লালা নিঃসৃত মুখে বলল, “কী আমার গায়ে হাত তুল্লি তুঁই? আমার গায়ে! কালিন্দ্যা নুয়ারের লক্তর গায়ে! দাঁড়া আইজকে তুখে–”

   মাটিতে হাত গেদে উঠতে গেল গুইরাম। কিন্তু মদের ঘোরে তা সম্ভব হল না। আবার আছাড় খেয়ে পড়ল ছাঁচকোলেই। তার বৌ পার্বতী ছুটে এসে ধরল তাকে। চিৎকার করল তারস্বরে, “অ লো, গঁড়ার বাপকে মাইরে দিলেক্ লো! তুরা ক্যা কুথাতে রইচিস্ আসবি রে। অরে অ্যা গঁড়া রে–”

   জনক অবশ্য ও চিৎকারকে তেমন আমল দিল না। নিজের বাহুতে হাত বোলাতে বোলাতে তাকাল বিকাশের দিকে। বলল, “যা, তুঁইঅ ঘরকে যা। ইখ্যানে দাঁড়াই থাইকে আর ঝামিলা বাড়াস্ নাই।”

   বিকাশ কথা বাড়াল না। পা বাড়াল বাইরের দিকে। কিন্তু দু’পা বাড়িয়েই থমে গেল। ঘুরে এল আহ্লাদীর কাছে। শুঁকনো হাসল একফালি। বলল, “আইজকে চল্লম গ রাঙাফুল। পারে আবার দিখা হবেক্। আর হঁ, সম্পক্ক আমাদের কিন্তুক্ ওইট্যাই রইলেক্।”

   আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিল না বিকাশ। বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর তার শিক্ষাগর্বী পা দুমদাম ফেলে এগিয়ে গেল বাইরের দিকে। গুইরাম পড়ে থেকেই জড়ানো গলায় চিৎকার করল, “হঁ-হঁ যা রে মা-মেগুয়া। তাবাদে কখনু কনু কাজে আমাদেরকে ডাইকতে আসিস্। তুদের দুয়ারকে মুইত্তেও যাব নাই রে আমরা। চাঁদির ছাঁয়ে নিকাপুড়া শিকিচে! নিকাপুড়া না আমার ক্যালার ডগটা শিকিচে।

   অনর্গল বাখান কেড়েই যেতে থাকল গুইরাম। আহ্লাদী দাঁড়িয়ে থাকল স্থির হয়ে। ভিতরে ভিতরে মনটা তার দমে গেল অজানা আশঙ্কায়। যদিও লোহারঘরের বিয়েতে মদ খেয়ে পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি নতুন কিছু নয়। তবু কেউ কাউকে অনুষ্ঠান ঘর থেকে ওভাবে তাড়িয়ে দেয় না। ঝগড়া লাগতে যেমন বিশেষ কারণের প্রয়োজন হয় না তেমনি তৎক্ষণাৎ তাকে ভুলেও যায়। আবার একসঙ্গে নেচে ওঠে বিয়ের গানে– পাল্লার গানে গলা মিলিয়ে। তাহলে তার শ্বশুর কেন এমন করল! এই প্রশ্নটাই ঘুলিয়ে বেড়াতে থাকল তার শরীর-মনকে। তবু ওই হোঁচট খাওয়া পাতান নতুন সম্পর্কটির রেস ধরেই মনে মনে বলল, “আমি যদি তুমার রাঙাফুল বটি থাইলে তুমি আমার পলাশ ফুল বট।”

   “ল্যা-ল্যা, আর দাঁড়াই দাঁড়াই ভাবড়া দেখতে হবেক্ নাই। বেলা অ্যানেক হলেক্। ইবারে বৌকে ঘরকে তুল।” জনক তাড়া দিল সকলকে। ভিড়টাও আবার ব্যস্ত হতে গেল। কিন্তু হেঁকে উঠল গুইরাম, “খবদ্দার বইলচি, কেউ ঘরকে লিবি নাই বৌকে। আয়, এগুয়াঁই আয় রে জনকা। আজকে দেখে লুব তুঁই কত বড় মরদ হঁইচিস্ ক্যালা! আয় বলচি, শালা হারামি!”

   পা বাড়াল গুইরাম। কিন্তু টাল খেয়ে একই ভাবে পড়তে গেল ছাঁচকোলে। পার্বতী ধরে ফেলে দাঁতে দাঁত ঘঁষে বলল, “অ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ– হ্যাঁ! একদম মাতাল ব্যাহেডট্যা হঁইয়ে গেইচে গ!”

   “কী, আমি মাতাল! তুর বাপ মাতাল রে শালি!”

   “হাঁ ভাল, বাপ কাড়াও নাই বলে দিলম।”

   “ক্যানে, কাড়ালে তুঁই আমার কীট্যা কইরে লিবি, আঁ? কাড়াব। একশ’ বার কাড়াব। হাজারবার কাড়াব। তুর বাপ মাতাল। তুর বাপের চোদ্দগুষ্টি মাতাল রে মাগি!”

   “হঁ-হঁ, আমার বাপের চোদ্ধুষ্টি মাতাল বলেই ত তারা কাজের ঘরকে আসা ছেল্যাকে বাখান কইরে খেদলেক্! একঘর কুটুমের সুমুয়ে ভাইয়ের সঙে গণ্ডুগুল লাইগে মইচ্চে!”

   “ব্যাশ কইচ্চি। আমি আমার ভাইকে বাখান কইরব, না সুয়াগ কইরব স্যা আমাদের ভাই-ভায়াদের বিপার বটে। তুঁই মাঝখ্যানে ঠ্যাঙ আড়ব্যার ক্যা বটিস্, আঁ? তুঁই কি উয়ার নাঙ বটিস্?”

   “হঁ বটি বৈকি! নাঙেই ত বটি। তাথেই ত উয়াকে আমি সামলাঁই বুলচি! ত হাঁই ল্যা। মরগা যাঁইয়ে।” কান্নাভেজা গলায় কথাক’টা বলল পার্বতী। কিন্তু সত্যিই ছেড়ে দিল না। বরং গুইরাম নিজের শরীরটা পার্বতীর হাতে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিল। তিরিক্ষি মেজাজে বলল, “চো-প শালি! আরেকটা কুথা বইল্লে তুর মু আমি গঁড়ারে ভাইঙে দুব। ভাইভাতারী ভাই ভাতার কইচ্চে আমার কাছটাতে আসে!”

   “এ দাদা, এই!” এতক্ষণে জনক এগিয়ে এল গুইরামের কাছে। পার্বতীর হাত থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল, “তুঁই ইয়াকে ছাড়ত বড়বৌ। আমি দেখছি।”

   “দ্যাখ ছুটুকত্তা, লিজের চোখেই দ্যাখ।” গুইরামকে ছেড়ে দিল পার্বতী। উদ্গত কান্নাটাকে চাপা দেওয়ার জন্য কাপড়ের খুঁটটা গুঁজে নিল মুখে। দাবাগলায় বলল, “এমনি করেই দিন দিন তুমার দাদাতে আমাকে বাখান কাইড়বেক্। আমি বলেই অখন উয়ার সঙে ঘর কইচ্চি। আর কেউ হইলে কবে হাতের লুয়া খুলে দিঁইয়ে পালাথক!”

   “হঁ-হঁ, তাই যা না। তাই যা।“ হেঁকে উঠল গুইরাম। “থাইলেও ত বাঁচথম। বাপ-ব্যাটাতে একেই দিনকে সাঙা কইরে বৌ ঘরকে তুলথম।”

   “হঁ রে রুগাচুদা! তা তুলবি নাই! তা ত তুলবিয়েই। একবার তুলেই দ্যাখ ক্যানে! তুর মু যদি আমি মুড়াঝাঁটা দিঁইয়ে গুঁড়া কইরে না দিতে পারি ত আমার নামেই পারি নুয়ারী লয়! হুঁ, সাঙা কইরবেক্! করাচ্চি উয়াকে সাঙা!”

   “আঃ, বড়বৌ! তুঁইঅ আবার লাইগে গেলি! ইয়ার কি অখন মাথার ঠিক রইচে! আর অ্যা দাদা! তুঁই ইসোব কী লাগালি বল দেখি? বল্লম, আর খাস্ নাই, খাস্ নাই। তখন ত আমার কুথা শুনলি নাই। আর অখন– এই দাদা, তুর কী হইলেক্ বল দেখিনি? আইজকের পারা দিনেও ইরকম বাখনাবাখনি–”

   “আইজকের পারা দিন বলেই ত লাগালম রে ভাই।” জনকের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিল গুইরাম। জড়ানো গলায় সোহাগ ঢেলে বলল, “ব্যাটার বিয়াতে একটুকুন মদ খাব নাই? একটুকুন ফুর্তি কইরব নাই? একটুকুন লাচ কইরব নাই?”

   “হঁ-হঁ, স্যা ত করবিয়েই।”

   “তবে? তুঁইয়েই বল না। ই দিনটা কি সোব দিনকেই আইসচে! বল, তুঁইয়েই বল!”

   “হঁ, স্যা ত বটেই। অখন চল দেখি, উদিগে যাই আমরা।”

   “কী! উদিগে যাব? না, কিছুতেই যাব নাই। আমি ইখ্যানট্যাতেই লাইচব। তুঁই গায়েন ধর দেখি! বল–

বলে তুখে লিঁইয়ে পালাব

আগাল ধারে

আগাল ধারে বাসা বানাব লো

আগাল ধারে।।”

নিজেই জড়ানোগলায় গেয়ে উঠল পাল্লার গান। বলল, “দ্যা দেখি, পাল্লা দ্যা দেখি। দেখি তুঁই কত বড় হাউসি গায়েনদার হঁইচিস্। হুঁ-হুঁ বাবা! অত সুজা লয়! কালিন্দ্যা নুয়ারের ব্যাটা বটি আমি। বাপে আমার পাঁচপাড়ার সদ্দার ছিলেক্। আয় চলে আয়, কন শালা পাল্লা দিবি আমার সঙে!”

   গুইরাম হাত-পা ছুঁড়ে তেড়ে উঠল। জনক শান্ত গলায় বলল, “হঁ-হঁ, দুব। আমিই পাল্লা দুব। আগে তুঁই উদিগে চল ক্যানে। ইখ্যানে উয়ারা অখন বৌকে ঘরকে তুলবেক্। উ সেই কখন থাইকে ঠায় দাঁড়ায় রইচে তুঁইয়েই বল ক্যানে!”

   “হঁ, ই কুথাটা তুঁই ঠিকেই বলিচিস্। অ্যা, লাগাঁই দ্যা রে সোব। ঘরকে তুলার পাটগুলান লাগাঁই দে। অ্যা গঁড়া, তুঁই ভাইলে ভাইলে দেখচিস্ কীট্যা? যা, বৌয়ের পাশকে যা। আমরা অখন দু’ভাইয়ে মেলে গায়েন বইলব। লায় রে জনকা?”

   “হঁ, বইলব ত। চল চল, তাগাদা কইরে উদিগে যাই।”

   আর কথা বাড়াতে দিল না জনক। গুইরামকে টেনে নিয়ে গেল উটোনের অন্য দিকে। ফোকলামাড়ির বুড়ি সে দিকে তাকিয়ে আবার শোলক কাটল, “বলে, ভাই লো আমি বইলব কী/নাঙকে আমি বাপ ডাকেচি!” তারপরই সকলকে তাড়া দিল, “অ্যা চল লো চল, বৌকে ঘরকে তুল।”

   এতক্ষণে গরবি একটি কুলো নিয়ে আহ্লাদীর সামনে দাঁড়াল। তাতে তেল, হলুদ, গিরিসিঁদুর, নোয়া আর কিছু ধান-দূর্বা সুন্দর করে সাজানো। কুলোটা পার্বতীর দিকে বাড়িয়ে ধরল। বলল, “কই লো বড়কি, ল্যা-ল্যা, কুলাটা ধর। বৌকে উলুতে ল্যা।”

   “বলে, দেখব কত কালে কালে/আম ধরিচে আমড়া ডালে। বলি হ্যাঁ লো–” ফোকলামাড়ির বুড়ি আবার শোলোক কাটল। খেঁকিয়ে উঠে বলল, “বলি লাজ-ধম্মর মাথা সোব খাঁইচিস্ নাকি লো, আঁ?”

   “ক্যানে গ খুড়ি? কী হলেক্?” অবাক হয়ে জানতে চাইল গরবি। তাতেই বুড়ির মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল। বলল, “কী হলেক্? বলি, নুয়ারঘরে কি এই পেত্থমটি সাঙালি বৌ ঢুকচে নাকি লো, য্যা বিয়ালি বৌ-এর পারা হলুদ-ত্যাল-সিঁদুর দিঁইয়ে উলুত্তে আসচিস্?”

   পঞ্চ মত দেওয়ার পর থেকেই লোহারসমাজের বিয়েতে যা যা লোকাচার করতে হয় তা সবই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে এরা। সে সব কানেও গেছে বুড়ির। কিন্তু মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। কাল থেকে একপ্রকার গায়ের জ্বালা নিয়ে অপেক্ষা করছিল আজকের বরণটির জন্য। তাই এখন আর স্থির থাকতে পারল না। গাজ্বালার সবটুকু বিষ উগরে খেঁকিয়ে উঠল, “কাইলকেও শুনলম, ছঁড়াকে হলোদ-ত্যাল মাখাঁইচিস্। জল ছাইতে গেইচিস্। ঘাটপূজা করিচিস্। হাঁ বাউনঠাকুদের ঘর থেকে ভাত আনে আইবুড়া ভাত দিঁইচিস্। বলি স্যা নাইলে করিচিস্, করিচিস্। কিন্তুক্ সাঙালি বৌকে কী বইলে বিয়ালির পারা করে ঘরকে তুলচিস্? বলি ধম্মে সইবেক্ ত? একেই ত নুয়ার আর বাবুঘরের মুড়াঝাঁটা, দুইয়ে ত কনুই ফারাক নাই! ছি-ছি– ছিঃ!”

   এতক্ষণে গরবি বুঝতে পারল বুড়ির ইঙ্গিত। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ক্ষেমীই বলল, “ই তুঁই কী বলচিস্ লো দিদিম্যা? অখন আবার উসোব আছে নাকি?”

   “তুঁই থাম লো ছুঁড়ি। নাই ত কী হঁইচে শুনি? ছৌতা-নেংটি ছাইড়ে সোব ছঁড়াতে প্যান্টালুম হাকাঁইচে বইলে কি লাজ-ধম্ম– হায়া-পিত সোব জলকে গেইচে?”

   “না দিদিম্যা, আমার দাদার ইট্যা সাঙাফাঙা লয়। ছুটুকাকাই ত বলিচে ইসোব কইত্তে!”

   “থাইলে আর কী! লায়কে যখন বলিচে তখন ত আর কুথা নাই! ধেইধেই কইরে লাচ সোব অই সাঙালি বৌকে লিঁইয়ে! তাও বলি, পাড়ায় কি একটা জুয়ান মদ্দাও নাই লো, আঁ, য্যা উয়ার ই অধম্মের মুয়ে ছিরছিরাঁই মুতে দিতে পারে! সোব কি নুয়ার বিটিদের লুয়া পইরে বসে রইচে। আজ থাকতক তুদের দাদুতে, তখন বুজতিস্! হুঁ-হুঁ, পাঁচপাড়ার লকে অমনি অমনি উয়াকে সদ্দার বইলে মানথক নাই লো!”

   জনক হয়তো এরকমই কিছু একটা আন্দাজ করেছিল। তাই গুইরামকে শান্ত করে চুপচাপ এসে দাঁড়িয়েছিল ভিড়টার পাশে। এখন গরবিকে উদ্দেশ্যে করেই খেঁকিয়ে উঠল, “কী হলেকট্যা কী? আহ্লাদীকে ঘরকে তুল। দাঁড়াই দাঁড়াই আর ভাবড়া দেখিস্ নাই সোব।”

   অমনি ভিড়টার মাঝে বয়ে গেল একটা মৃদু গুঞ্জন। কিন্তু কেউ রা-কাড়তে পারল না। বুড়িও গজগজ করতে করতে বাইরের দিকে পা বাড়াল। বলল, “থাইলে হাঁইলে। তুরা যা ভাল বুজিস্ তাই কর। আমি আর ক্যা বটি বল! তবু আমি বইলে যেছি, অ্যাত বাড় ধম্ম সইবেক্ নাই। বাবা, অমন কুথা ত বাপের জম্মতে শুনি নাই! সাঙালি বৌকে লিঁইয়ে আদিখ্যাতা গ, আঁ!

   কিন্তু বুড়ির গজগজানির কেউ উত্তর দিল না। পার্বতী গরবির হাত থেকে কুলোটা নিল। ঠেকাল আহ্লাদীর কপালে। বাকিরা হ্লুধ্বনিতে ব্যাকুল করে তুলল গ্রীষ্মশেষের বাতাসকে।

অনুকথা

(নয়)

   “সাঙাৎ, অ্যা সাঙাৎ! কুথাক্ গেলে হ্যা?” বুড়ো তেঁতুলতলাটার দিকে এগিয়ে এল সাগরা। তার দু’হাতে দু’টো জামবাটি।

   “হঁ, আমি ই দিগে রইচি।” গাছের গোড়াটার আড়াল থেকে সাড়া দিল জনক। সাগরা এসে দেখল, জনক দু’হাতে হাঁটু জড়িয়ে বসে আছে। তাকিয়ে আছে দূর– কৃষ্ণচূড়া-আগুনের দিকে। সাগরা গদগদ হয়ে বলল, “অ, তুমি ইদিগে রইচ! আর আমি তুমাকে কুথায় কুথায় খুঁজে মচ্চি। হাঁই ভাল ক্যানে হ্যা সাঙ্গাৎ, তুমার লাইগে কী লিঁইয়ে আলম!”

   জনক তার দৃষ্টি গুটিয়ে নিল। তাকাল সাগরার হাতের দিকে। দৃষ্টিকে আবার বিছিয়ে দিল দূরের আগুনরঙে। উদাস গলায় বলল, “অখন আবার তুঁই ই সোব কী কইত্তে আইনতে গেলি?”

   “খাইতে আবার কী কইত্তে! তুমি য্যা কী বল নাই সাঙ্গাৎ!”

   তবু দৃষ্টির শূন্যতা মুছল না জনকের। সাগরা অবশ্য সেসব খেয়াল করল না। জামবাটি দু’টো নামিয়ে রাখল জনকের পাশে। ছৌতার কড়চ থেকে বের করল শালপাতার মোড়কটা। সেটা মেলে ধরে আপন মনেই বলল, “সেই কাইলকে রেতের বেলায় বিয়াই ঘরে যা একটুকুন মুয়ে ঠেকাঁইছিলে। তাবাদে ত আর ই সোব ছুঁয়েও দেখ নাই। সুবাই মেলে কত ফুত্তি কইল্লেক্! আর তুমি! একলাটি সোব সামলাঁই বেড়ালে। লাও-লাও, ঝটপট ইটুকু মুয়ে দাও ত। তাবাদে যা বটে বটে!”

   জনক ঘুরে বসল সাগরার মুখোমুখি। জিজ্ঞাসা করল, “অখনি মাছ ভাজা কুথাতে পালি রে?”

   “ই ক’টা কাইলকের বাসি বটে হ্যা। সাঙ্গাতানকে বইলতেই বার কইরে দিলেক্। ক্যানে, লিঁইয়ে আসে ভাল করি নাই?”

   “হঁ, ভালই ত করেচিস্।”

   “হে-হে-হে– স্যা আর বইলতে আছে সাঙ্গাৎ! খালি মুয়ে কি আর মাড়ি জমে হ্যা! তুমিয়েই বল ক্যানে? লাও-লাও, তাগদা কইরে একঢোক মাইরে লাও ত– হে-হে-হে!”

   গতকাল থেকে লোহারপাড়ার সকলেই কমবেশি নেশা করেছে। কেউ হাঁড়িয়া, কেউ বা পাকি, যাকে চলতি কথায় বলে চল্লু। আবার যাদের হাতে কাঁচা পয়সার আমদানী আছে তাদের কেউ কেউ সিক্সটি, এমনকি দু’একজন তো বিলিতি রামও। খেয়েছে। মাতাল হয়েছে। নেচে-গেয়ে মেতে উঠেছে। ফুর্তি লুটেছে যে যার মতো। সে খবর যে জনক না জানে তা নয়। নিজের জিভেও লালসা জেগেছিল বৈকি। কিন্তু সাহস করেনি। অবস্থা আর আগের মতো নেই। সর্দারিত্ব তো নেই-ই। সে তো কালিন্দীই জলাঞ্জলি দিয়েছিল। তবু পার্টি করার সুবাদে রোয়াব তার মন্দ ছিল না। কিন্তু এখন! সবদিকে কেমন যেন একটা বেপরোয়া ভাব। কেউ কাউকে মানতে চায় না। অথচ এই ক’বছর আগেও তার বাপ কালিন্দী লোহারের হাঁক শুনলে বুকের রক্ত শুকিয়ে যেত সকলের। তার মেজাজকেও তো কম মেনে চলত না লোহার পাড়াটা। কিন্তু ইদানীং! মুখে কেউ কিছু বলে না ঠিকই, তবু জনক অনুভব করে তলায় তলায় ফাঁকা হচ্ছে হাঁসপাহাড়ির জঙ্গল। ষোলআনার গরুবাথান থেকে শোনা যায় উড়ন্ত ঠেঁঠি পাখির শব্দ– হুট্ট-ঠেঁটি-হুট্! এ যে আসলে বিপদ সংকেত তাও জানে জনক। তার উপর এই বিয়েটা নিয়ে একটা অশান্তির কালোমেঘ সবসময় উঁকি দিয়েই ছিল পশ্চিমের আকাশ-কোণে। তাই সবসময় জনক চোখকান সজাগ রেখেছে। কিন্তু এত দিনের নেশা! সে বাগ মানবে কেন! ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুলেছিল তাকে। তাই এখন আর কথা বাড়াল না জনক। বাটিভর্তি হাঁড়িয়া একচুমুকে শেষ করে ফেলল। তৃপ্তির ঢেকুর তুলল একটা। সাগরাও অন্য বাটিটা হাতে তুলে নিল। হাঁড়িপানা মুখের রোমহীন ভ্রূ নাচিয়ে কৌতূক করল, “কী সাঙ্গাৎ! ক্যামন পারা লাইগলেক্ বল নাই?”

   “ভাল। খুবেই ভাল বটে।” মুখে হাঁড়িয়ার স্বাদ লাগতেই জনকের মুখের উদাস রেখারা সতেজ হয়ে এল। শালপাতার মোড়ক থেকে তুলে নিল একটা মাছভাজা। গলাটিও উঠে এল মিঠাতে। বলল, “তুমার আনা মদ কি কখুনু খারাপ হতে পারে হ্যা সাঙ্গাৎ!”

   “উঁহু-উঁহু, তার লাইগে লয়।” দু’দিকে মাথা নাড়ল সাগরা। ভাতভর্তি ফুটন্ত হাঁড়ির মতো বগবগিয়ে বলল, “নিজের হাতে পাতা মদ! স্যা কি আর ভাল না লাইগে যায় হ্যা সাঙ্গাৎ! তাবাদে আমি কি জানি নাই, কালকের থাকের তুমার পেরাণটা ক্যামন হঁকপকাচ্চে গলাটা একটুকুন ভিজাবার লাইগে!” সাগরা নিজের বাটি শেষ করে একখণ্ড মাছ তুলে নিল হাতে। তাতে একটা কামড় দিয়ে আবার বলল, “তবে যাই বল ক্যানে সাঙ্গাৎ, ই ছাড়া কি আর মদ হলেক্ হ্যা! উ তুমি দ্যাশি-বিদ্যাশি– রাম-লক্ষণ যাই বল ক্যানে! ইয়ার আগে কিছুয়েই লাগে নাই। আমি ত কালকে–”

   হঠাৎ জিভ বের করে থেমে গেল সাগরা। মুহূর্তের মধ্যে মুখের সমস্ত রঙ গেল উড়ে। বেরিয়ে আসতে চাইল তার সদাবিস্ফারিত চোখজোড়া। ঝপকরে মাছখণ্ডটা ফেলে দিল শালপাতার উপরে। জনকের একটা হাত আকঁড়ে ধরল। হড়বড় করে বলল, “বিশ্বেস যাও সাঙ্গাৎ, আমি লিজের থাইকে খাই নাই। উ ছেল্যাগুলান জোর কইল্লেক্– তাথেই একফুঁটা– বিশ্বেস যাও, এই ইতুটুকু– মানে কুথা, একঢোক– মা মনসার কিরা লিঁইয়ে বলচি। বাবা বঙা ঠাকুরের কিরা– বাবা কালভৈরবের–”

   “হা-হা-হা–” তারস্বরে হেসে উঠল জনক। সাগরা আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলল, “সাঙ্গাৎ, রাগ কইল্লে? অ্যা সাঙ্গাৎ! বল নাই, রাগ কইল্লে নাকি?”

   বেশ খানিক হেসে থামল জনক। নেশালু দৃষ্টি পাতল সাগরার ড্যাবরা চোখতলায়। অদ্ভূত মায়ামাখানো গলায় বলল, “তুমি অত ভালটি ক্যানে হইলে সাঙ্গাৎ?”

   “আঁ!”

   “বইলচি, ক্যানে তুমি অত ভালটি হলে?”

   “ধুর, তুমি য্যা কী বল নাই সাঙ্গাৎ!” নতুন কনেটির মতোই লাজে রাঙা হয়ে উঠল তেঁতুলগাছের গোড়টা। লাজরঙ লাগল পাতাশূন্য কাচমলাডালে বসা মালাঘুঘুটার ঠোঁটেও। সোহাগচুমুর পুলক নিয়ে একপা সরে বসল পার্শ্ববর্তীর থেকে। সাগরার অবশ্য অততে খেয়াল নেই। লাজে ভেঙে পড়ে বলল, “আমার থাইকে ত তুমি অ্যানেক ভাল। যাকগুয়া, উসোব ছাড়ান দাও। খাও ত খাও। মাছভাজা খাও।”

   তবু জনক ঘোরলাগা মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকল সাগরার দিকে। দেখে দেখে যেন তার খেদ মিটছে না কিছুতেই। সাগরা সেদৃষ্টির সামনে নিজেকে ধরে রাখতে পারল। অযথা জল চলে এল চোখে। ভাঙাগলায় বলল, “ই রকম কইল্লে আমি কিন্তুক্ কাঁদে দুব সাঙ্গাৎ!”

   “আচ্ছা ব্যাশ, তুমাকে কাঁদতে হবেক্ নাই। যাও আরেক জাম লিঁইয়ে আস।”

   “হঁ, সেই ভাল। তুমি ইকলাটি বইস একটুকুন। আমি এই যাব আর আইসব।”

   লদপদ করতে করতে খালি জামবাটি দু’টা নিয়ে সাগরা ছুটল গুইরামের ঘরের দিকে। জনক দৃষ্টিটা কিছুক্ষণ ধরে রাখল সাগরার হিল্লোলিত পিঠে। তারপর দৃষ্টিরেখা গুটিয়ে নিল। পাতল সামনের খাঁ-খাঁ মাঠে। অমনি হুস্করে মনটা আবার ভারী হয়ে গেল। সেভার লাঘব করতে লম্বা করে শ্বাস নিল। ধরে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর দু’হাতের বেড়ে হাঁটুজোড়া জড়িয়ে লম্বা করেই ছেড়ে দিল সেটাকে। কিন্তু তাতেও বিশেষ সুবিধা হল না। দৃষ্টিটাকে আবার বিছিয়ে দিল কৃষ্ণচূড়া লালের দিকে।    

   গুইরামের মাতলামিটুকু আর ফোকলাবুড়ির বিবাদটুকু বাদ দিলে সব পেরিয়ে গেছে ভালোভাবেই। আজ সন্ধ্যায় পাড়ার মুরুব্বিরা একবার আহ্লাদীর হাত থেকে হাঁড়িয়া গ্রহণ করলেই আর কোনো বাধা থাকবে না। তবে এখন তা নিয়ে ভাবতে চাইছে না জনক। মনটা তার কু ডাকছে অন্য কারণে। সেদিন হুমকি দিয়েছিল সুভাষ মান। তবে বাহ্যিক আচরণে তার সে ভাব নেই। পারতপক্ষে এমুখোও হয় না। যদিও এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে লোকসভা নির্বাচনের প্রচার। কিন্তু একদিনও জনক তাতে যোগ দেয়নি। তার জন্যেও মনটা তার হু-হু করছে।

   এই যেমন এখন! হাঁড়িয়ার নেশা যতই চেপে বসছে মাথায় ততই বৈশাখী লু-এর মতো হু-হু করছে তার মনের আনাচকানাচ। আর ওই গাছ-আগুন! যতই ঝলসে দিচ্ছে তার চোখ ততই কি পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে না তার জেদও! ওই লাল! রক্ত-আগুন লাল! কী করে সে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবে! ওতেই যে মিশে আছে তার বাপ কালিন্দী লোহারের তাজারক্ত।

   “না-না, কিচ্ছুটি ঠিক হছে নাই! আমি কিচ্ছুটি ঠিক কইত্তে লাইচ্চি।” হু-হু করে কেঁদে উঠল জনক। মুখখানা গুঁজে দিল দুই হাঁটুর ফাঁকে। কাটা ছাগলের মতো থরথরিয়ে কাঁপতে থাকল তার পিঠ। মাথাটা হাঁটুতে ঘঁষতে ঘঁষতে গুমরানো স্বরে বলল, “বাপ্ হ্যা! আমি তুর কুলাঙ্গার ছাঁ বটি হ্যা বাপ্ আমার। আমাকে তুঁই ক্ষ্যামা করিস্ নাই বাপ্। ক্ষ্যামা করিস্ নাই।”

   “জনকা– জনকা রে-এ-এ-এ-এ-এ–” হঠাৎ জনক শুনতে পেল তার নাম ধরে ডাক। যেন বহুদিন আগে, বহুদূর থেকে কেউ এমনিভাবেই তাকে ডেকেছিল। আর আজ তা তার কানে পৌঁছাচ্ছে। ডাকটা কানে জাগতেই ঝট করে সোজা হল জনক। কান পাতল হাওয়ায়। অস্ফুটে বলল, “ক্যা? ক্যা বটিস্ রে?”

   “আমি বটি রে জনকা–আ-আ-আ-আ-আ– আমি-ই-ই-ই-ই–”

   “আমিট্যা ক্যা বটিস্ সেইট্যা বলবি ত আগে?”

   “আমি তর বাপ্! কালিন্দী নুয়ার রে-এ-এ-এ-এ!”

   “আঁ! বাপ্! আমার বাপ্!” উন্মাদের মতো চারিদিকে তাকাতে থাকল জনক। কিন্তু কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হল না। বরং একটু আগেও যা ছিল স্পষ্ট তাই এখন ধোঁয়াশায় ভরে গেছে। সেই ধোঁয়াশার মধ্যে নিজের দৃষ্টি ডুবিয়ে আবার ডাকল জনক, “বাপ্! তুঁই আমার বাপ্ বটিস্!”

   “হঁ রে-এ-এ-এ-এ-এ–”

   “বাপ্, তুঁই কুথাতে রইচিস্ বাপ্? আমি তুখে দেখতে পেছি নাই ক্যানে?” একইভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল জনক। আকুল গলায় বলল, “একবার দ্যাখা দ্যা বাপ্। আমার য্যা তুখে দমে দরকার বটে রে বাপ্! আমি য্যা ইকা ইকা কিছুই বুঝতে লাইচ্চি! কইত্তে লাইচ্চি বাপ্!”

   “জনকা রে-এ-এ-এ-এ– আমাকে বাঁচা রে বাপ্! আমি য্যা খাদের ভিতরে সীমাঁই যেছি বাপ্ আমার।”

   “আঁ– খাদ! কই, কুথাতে?” জনক ধোঁয়াশার ঘেরাটোপ ভেদ করে দেখতে চাইল সামনে। অমনি তার নজরে এল সত্যিই একখানা বিরাট গহ্বর। অনেকটা খন্নামাঠের ভুসগাড়ের মতো। তাতে দেখা যাচ্ছে একটা মাথা। ঢেউ খেলান ঝাঁকড়া চুলের গাছি ছড়িয়ে রয়েছে গর্তের মুখে। আর সেখান থেকে গলগল করে বেরোচ্ছে রক্ত। লাল হয়ে উঠছে কাদামাটি। সেই লাল ভেদ করে দু’টো পেশিবহুল লোহার হাত যেন আকুল হয়ে ডাকছে তাকেই। জনক চিৎকার করল “বাপ্! আমি যেছি রে বাপ্! তুর কনু ভাবনা নাই। যেছি আমি।”

   উঠে দাঁড়াতে গেল জনক। অমনি টাল খেয়ে পড়ল ধপাস করে।

   “ই বাবা, সাঙাৎ! একজামেই তুমার লেশা হঁইয়ে গেইচে নাকি হ্যা!” সাগরা আবার দু’জামবাটি ভরা হাঁড়িয়া নিয়ে দাঁড়াল তেঁতুল তলায়। হেসে উঠে বলল, “হে-হে-হে– হবেক্ নাই ক্যানে। কাল থাইকতে ত একরকম উপাসেই যেছে তুমার। লাও-লাও আরেক জাম মাইরে দাও ত! দ্যাখ সোব ঠিক হঁইয়ে যাবেক্।”

   ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চোখে তাকাল জনক। দেখল আগের ধোঁয়াশা উধাও। জ্যৈষ্ঠশেষের রোদে ঝলমল করছে চারিদিক। ঠোঁটনেড়ে বিড়বিড় করল জনক, “তুঁই? সাগরা!”

   “হঁ ত, আমিয়েই বটি। তুমার সাগর সাঙ্গাৎ। লাও-লাও, যা সরেস হঁইচে নাই মদটা।”

   টলবল করতে করতে সাগরাও বসল জনকের পাশে। জনক উঠে বসল। বলল, “থাইলে উগুলান কী ছিলেক্!”

   “কনগুলান? অ! উগুলান? উগুলান ত মাছভাজা বটে গ! না হ্যা সাঙ্গাৎ, মনে ল্যায় তুমার দমে লেশা হঁইয়ে গেইচে!”

   আর কিছুই বলল না জনক। ভাল করে চেয়ে দেখল চারিপাশটা। মনে মনে বলল, “নাঃ, সোবেই ত ঠিক রইচে। অই ত কিষণচূড়াতে জ্বলচে দাউ-দাউ আগুন। তার আশপাশে ধু-ধু কইচ্চে ডাঙামাঠ। অই ত কাচমলা ডালে ঘুঘু দু’টাতে সুয়াগ মারাচ্চে। এই ত তেঁতলতলের ছাওয়াতে পড়ে রইচে মাছভাজা ক’টা। থাইলে কি আমি স্বপুন দেখছিলম! নাকি বাপ্ আমার ভুত হঁইয়ে– না-না, তা লয়, তা লয়। তা হবেক্ ক্যানে!”

   হঠাৎ ভাবনার গতিতে রাশ টানল জনক। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল হাঁড়িয়াভরা জামবাটি। একচুমুকে শেষ করল সবটুকু। গামছা দিয়ে মুছে নিল কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়া রস। চোখ বন্ধ করে বসল। হেলান দিল গাছটার গুড়িতে। অমনি কানে বেজে উঠল গতকালকের পুকুরপুজোর গান,

“সিলত লড়েচড়ে পায়রা ঘুমে রে

আজ ক্যানে বরের মা তুর হিয়া বিদুরে

গুসাঁইদের বাড়িতে অগো বলি পাকা কুঞ্জরি

গুসাঁইদের বৌ দাঁড়াই আছে অতি সুন্দরী

টুকুটুকু জল দাও মা জলমা ঠাকরাণ

ঘটি ভরে জল দাও মা ঘটি ভরে জল দাও

আমি রাজার বিয়া দুব

ম্যাগ দুলদুল করে অহ্যা রাজা হ্যা

আজ ক্যানে বরের মা তুর হিয়া বিদুরে।।”

   এই তো তাদের দস্তুর। পুকুরের জলের কাছে নতজানু হয়ে অনুমতি চায় ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়ার। নতুন প্রজন্ম আনার। সে-ও তো চেয়েছে। তেপথির পাথরে আর শ্যাঁওড়াগাছে সুতো জড়িয়ে গেয়েছে,

“শ্যাঁওড়া গাছে সূতার খি

তুমায় বড সাজে

তুমার কইন্যা আদরিনী

লাল দরগা খুঁজে।।”

তাহলে কেন মনের মধ্যে থির বাঁধছে না গঁড়া-আহ্লাদীর মঙ্গলচিন্তা! কেন বারবার কেঁদে আকুল হচ্ছে মন!

   এই তো এখন। মাথা থেকে সরে যাচ্ছে মাঙ্গলিক গানের সুর। জেগে উঠছে কেলিয়ার মুখ। তাদেরই পাড়ার। তারই মতো। তবু তার সঙ্গেই আজ মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা তার। অথচ এই কি চেয়েছিল সে! চাষ করে দেউয়ীর যোনি যোতবার মতো ক্ষমতা তার আছে! যদি থাকেই তাহলে কেন বারবার মনের মাঝে শুনতে পায় দেউয়ের গাওয়া কাঠিনাচের গান! কেন কান্নার সুর এসে কানে ফিসফিসিয়ে যায়–

“আহা চাষ চাষ কর দেউয়ী চাষ বড় জঞ্জাল

আমি কুথায় পাব লাঙ্গল-গরু কুথায় পাব হাল গো

আমি কুথায় পাব কাস্ত্যা কদাল কুথায় পাব ফাল

আমার সকল কিছু হারাঁইয়ে যে ই ভিখারির হাল গো…”

   এ গান তো তার বাপ্ কালিন্দী লোহার প্রতিবছর দুর্গাপুজোতে গেয়েছে। যখন মেয়েসেজে কাঠিনাচ করে মাগনে বেরোত তারা। মেয়েদের পরনের কাপড়কে পরত ঘাগরার মতো করে। বুকে পরত ব্লাউজ। কানে দস্তার দুল। চোখে কাজল। হয়তো তার বাপের বাপ, তার বাপের বাপ– বাকি যত পূর্বপুরুষ, তারাও এভাবেই চাষের জমি হারিয়ে কেঁদে ফিরেছে দ্বারে দ্বারে– “চাষ চাষ কর দেউয়ী চাষ বড় জঞ্জাল…” আর তার রক্তে বাসা বেঁধে রয়েছে সে যন্ত্রণা। সেই জন্যেই এই কান্না। হবেওবা।

   জনক আর ভাবতে চাইল না কিছু। ভাবনার ভারকে সরিয়ে তাকাল চোখমেলে। ডাকল, “আচ্ছা সাঙাৎ, তুমার কী মনে ল্যায়? আমি কিছু ভুল কইল্লম? এই য আহ্লাদী ঘর আল কইরে আলেক্, ইট্যা বেশি ভাল হলেক্! নাকি নাড় হঁইয়ে বাপের ঘরে পইড়ে থাকাটাই উয়ার ভাল ছিলেক্? উয়ার স্বুয়ামীতে মাঠে হাল বাঁইতে যাঁইয়ে বাজ পইড়ে মলেক্, ত উয়াতে আমার আহ্লাদী মায়ের কী দোষট্যা ছিলেক্, তুমিয়েই বল ক্যানে! তাবাদে ধর ক্যানে, উ তখন কতটুকুনেই বা! ত, উয়ারেই কি সাদ জাগে নাই ঘরবর লিঁইয়ে সমসার কইত্তে! কই, আমি উয়ার বাপ-মায়ের কাছে কথাটি পাইড়তে উয়ারা কেউয়েই ত একবারঅ না বল্লেক্ নাই! মেইয়্যাট্যাতেও ত না বইল্লেক্ নাই! থাইলে, ইট্যা ভাল হলেক্, নাকি–”

   কিন্তু তার ডাকের কোনো সাড়া দিল না সাগরা। বদলে জনক শুনতে পেল নাকডাকার শব্দ। অমনি তাকাল তার পাশের দিকে। দেখল বেঢপ শরীরটা মাটিতে বিছিয়ে দিয়েছে সাগরা। গভীর ঘুমে অচৈতন্য হয়ে তার নাক জানান দিচ্ছে শরীরীক্লান্তির বহর।

   “ই শালা! ঘুমাই দিঁইচে য্যা রে ব!” নিজেকে শোনানোর মতো করেই কথা ক’টা আওড়াল জনক। হাত বাড়িয়ে ডাকতেও গেল। কিন্তু পারল না। কিছু একটা ভাবল। সাগরার হাঁ মুখের দিকে তাকাল। দেখল একটা মাছি সেখানে ভনভন করছে। সেটা হাত দিয়ে তাড়িয়ে দিল জনক। নরম গলায় বলল, “সাঙ্গাৎ আমার একদম ছুটু ছেল্যাটির পারা। নাঃ, ঘুমাক্। সারারাত যা মাতুনি করিচে!”

   একটুখানি মুচকি হাসল জনক। হাতটা গুটিয়ে নিল। ফিরিয়ে নিল নেশাগ্রস্ত দৃষ্টিও। চোখজোড়াকে ভাসিয়ে দিল দূরে। দেখল, সেখানে এখনও দাউ দাউ করছে লাল-আগুনের সমারোহ। জনক দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বিড়বিড় করল, “বাপ্ হ্যা! অ বাপ্ আমার!”

পথের কবিতা

হাইরাইজহীন ধু ধু সোনালী শূন্যতার কাছে

জয়দীপ রায়

জয়শলমীর ছাড়ার পরে স্যামের রাস্তায় যেখান থেকে চারিদিকই মোটামুটি দিগন্ত হয়ে গেল, সেখানে গাড়ী থামাতে বললো হাতিরাম। গাড়ী থেকে নামলো। আমি আর সুজনদা বসে থাকলাম। বসে থেকে দেখতে লাগলাম কি করে! প্রথমে একটা আড়াল দেখে বাথরুম করতে গেলো। তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরেও আড়ালই নেই তো কোথাও। ঝোপঝাড়ও নেই। খানিকটা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালো, তারপর আমাদের একবার দেখে নিয়ে দূরে চলে গেলো।

আমরাও নামলাম। গাড়ীর ভিতরের আর বাইরের টেম্পারেচার এক। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, হাওয়া এখনও বেশ নরম মরু অঞ্চলে। মরুভূমিতে আসলে দেখলাম বোঝা যায় পৃথিবীটা আসলেই গোল। পুরো গোলক না হলেও অর্ধগোলক তো বটেই। একটা গোল্ডেন রংয়ের গোলাকার বেডের মধ্যেখান দিয়ে চলে গেছে কালো অ্যাসফাল্ট। নিরক্ষরেখার মত। এছাড়া পৃথিবীতে আর যা কিছু আছে, সব নীল রংয়ের। উপুড় করা বাটির মত মাথার উপর ছেয়ে রয়েছে গভীর নীল আকাশ। তাতে সাদা দাগের মত মেঘের হাইলাইটার।

হাতিরাম দূর থেকে ফিরে এসে মাইল পোষ্টটার পর ডাঁটসে বসলো। একটা মাইল পোষ্ট যেন আমাদের জন্যই পোঁতা হয়েছিল। একটা রাস্তা, বৃত্তাকার দিগন্ত ছোঁয়া পতিত জমি আর আকাশ-ভরা সূর্য-তারা ছাড়া এ পৃথিবীর আর কোনও জিনিস নেই যেটা আমরা ছুঁয়ে দেখতে পারি। কোনও পানের দোকান, ফুল ঝরে যাওয়া সর্ষের ক্ষেত, অন্তত একটা সবুজ টিলা। ঝড় আসলে জড়িয়ে ধরার মতো কোনও গাছ। স্যাম তেইশ লেখা মাইল ফলকটাই আমাদের একমাত্র উঁচু আশ্রয়। সেটার পরে বসেই হাতিরাম এমন কিছু করতে লাগলো,  যাতে আমি বুঝলাম ছবি তোলাতে চাইছে। ছবিই তোলায় হাতিরাম। ফেসবুক করে না বলে পোস্টাতে পারে না।

গাড়ী চলছে। রোড সিনেমার মতো রাস্তা। কদাচিৎ কোনও গাড়ী আসছে। এবার হাতিরাম চালাচ্ছে। হাতি চালালে আমার খুব ভয় লাগে। নামে হাতি, গাড়ী চালায় টাট্টু ঘোড়ার মতো। যদিও এমন রাস্তা কোনও গাছের সঙ্গেও ধাক্কা মারতে পারবে না। কোনও রেলিং দেওয়া খাদের ধারও নেই। না কোনও নয়ানজুলি। অ্যাকসিলারেটর চেপেই যাচ্ছে হাতিরাম। একশো-একশো দশ-পনেরো… বলতে বলতেই পুলিশ ধরলো। রাস্তার বাঁদিকে হাইওয়ে প্যাট্রোল দাঁড়িয়ে। স্পীড লিমিট একশো। ক্যামেরা তাক করা সোজা রাস্তার দিকে।

পুলিশ ভ্যানটাকে পেরিয়েই বাঁদিক চেপে গাড়ী দাঁড় করালো হাতিরাম। ড্রাইভার গেল পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে। আমি আর সুজনদা গাড়ী থেকে নামতেই একদল হতদরিদ্র বাচ্চা বাচ্চা ছেলে এসে আমাদের প্রায় ঘিরে ধরে টাকা খাবার দাবার চাইতে লাগলো। একদল ক্ষুধার্ত রেগিস্তানি বালক। কি দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো কাছে বেশ কয়েক প্যাকেট ক্রিম বিস্কুট আছে। আমাদের রেডী লাঞ্চে দুচার প্যাকেট বিস্কুট সঙ্গে থাকেই। বিস্কুটের থলেটা হাতে নিয়ে খুব আনন্দ হল। বেশ কয়েক প্যাকেট আছে। মনে হয় সবাইকেই দিতে পারবো। এক এক করে দিতে দিতে প্রায় শেষ হয়ে এলো বিস্কুটের প্যাকেট। শেষের দিকে হাত থেকে যেন কেড়ে নিতে লাগলো এক একজন। বুঝতে পারছিল যে শেষ জন অব্দি পৌঁছবে না। রাজস্হানে প্লাস্টিকের ব্যবহার কম। দোকানে দোকানে সিন্হেটিক শাড়ি কেটে তৈরী করা মুখে দড়ি বাঁধা এক রকমের থলেতে করে মালপত্র দেওয়া হয়। বিস্কুটের দোকানদারও এরকম একটা কালারফুল থলেতে সব প্যাকেট গুলো ভরে দিয়েছিল। সব শেষ হয়ে যাবার পরও কি একটা ছিল যেন। তবে বিস্কুট না।

থলেটা আমার হাত থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিল একটা ছেলে। রীতিমত গায়ের জোর খাটিয়ে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পুলিশ জিপের পাশে থেকেও ভয় পেয়ে গেলাম। তারপরেও সবাই মিলে হাত বাড়িয়ে দে দে করতে লাগলো। হাতিরাম বিরক্ত হচ্ছে। ড্রাইভার গিয়ে পুলিশকে ধোঁকা দিয়ে ফাইন আটকেছে। সাব ভি ডিপার্টমেন্ট মে হ্যায়, বলে গাট্টা গোট্টা চেহারার হাতিরামজিকে দেখিয়ে দিয়েছে। হাতিরামও পুলিশের দিকে তাকিয়ে একবার হেসে ড্যাশ বোর্ডের উপরে রাখা সানগ্লাসটা পরে নিয়েছে। আমি তো এতসব কিছু জানি না। বাচ্চাগুলোর দিকেই সময় চলে গেছিল আমার। হাতি বেশ কবার তাগাদা দিয়েছে যাবার জন্য। পুলিশ আবার ক্রশ চেক না করে।

হাতিরামের কুইক অ্যাক্সিলারেশানে খিদের ভারতবর্ষ দ্রুত ফেড আউট হতে লাগলো। রাজস্হানী গাড়িতে সুমনের বাংলা গান বাজছে, চেনা দু:খ চেনা সুখ/ চেনা চেনা হাসিমুখ/ চেনা আলো, চেনা অন্ধকার…। ছিনতাইবাজ ভারতবর্ষকে পিছনে ফেলে আমরা আবার শূণ্যতার দিকে এগিয়ে গেলাম। মাঠের পর ফাঁকা মাঠ। দিগন্তের পর খালি দিগন্ত। গাছহীন, হাইরাইজহীন ধু ধু সোনালী তেপান্তরের মধ্যে আমরা হারিয়ে গেলাম।