আমার জীবন
শুভংকর পাত্র
(পর্ব ১)
আমাকে অনেকেই আমার পাখি দেখা, প্রজাপতি ফড়িং গাছপালা এইসব দেখা নিয়ে লিখতে বলেছে, এখনও বলে। অনেক সময় আমি ভেবেছি লিখবো। তারপর ভেবে দেখলাম, নতুন কী আর লিখবো, সবই তো জানা। আমার আরো একটা সমস্যা হলো, এইসব দেখাটা যতো সহজ, আমার পক্ষে লেখাটা ততো সোজা নয়। তবু শেষমেশ ঠিক করলাম, লিখবো। চেষ্টা করেই দেখি না পারি কিনা। তবে এটা বুঝতে পারছি, লেখাগুলো এলোমেলো হয়ে যাবে, পারম্পর্য বজায় থাকবে না। দ্যাখা যাক।
আমরা মাঝে মাঝে নদিয়ার চারটে জায়গায় যাই।
এক : জাগুলি গ্র্যাসলান্ড।
এখানে প্রধানত ইয়েলো-আইড ব্যাবলার আর লেসার কুকাল দেখতে যাই। গরমকালে গেলে কমপক্ষে ১৫-২০টা ইয়েলো-আইড ব্যাবলার আর ঐরকমই ১৫-২০টার মতো লেসার কুকাল দেখতে পাওয়া যায়। আমরা কখনও কখনও আরো বেশিও পেয়েছি। এই সময়, এই গরমকালে এদের বাসা করার সময়, ডিম পাড়ার সময়, তাই এদের ওড়াউড়ি আনাগোনা ডাকাডাকিও বেশি। ফলে সহজেই এদের দেখা পাওয়া যায়। আর, জায়গাটা এমনই, ভালো ছবিও পাওয়া যায়। যারা জাগুলিতে গেছে, সবাই-ই ভালো ভালো ছবি পেয়েছে।
জাগুলি ছাড়া দক্ষিণবঙ্গে আর কোথাও এতো ইয়েলো-আইড ব্যাবলার আর লেসার কুকাল পাওয়া যায় না। এছাড়াও আমরা এখানে আরো অনেক রকমের পাখি দেখেছি। যেমন এক্ষুনি মনে পড়ছে:
কমোন উডশ্রাইক, ব্ল্যাক-হেডেড কুক্কুশ্রাইক, রেড-ব্রেস্টেড ফ্লাইক্যাচার (ব্রিডিং মেল), ইস্টার্ন মার্শ হ্যারিয়ার, জ্যাক স্নাইপ (অর্ক কর্মকার ছবি তুলেছিলো), অনেক ব়েড-কলার্ড ডাভ, অজস্র প্লাম-হেডেড প্যারাকিট, এইরকম আরো অনেক পাখি।
শীতকালে এখানে অন্তত ২৫-৩০টার মতো সাইবেরিয়ান রুবিথ্রোট পাওয়া যায়, খুব ভালো ছবিও তোলা যায়, অনেকের কাছেই আছে।
যারা প্রজাপতি দ্যাখে, প্রজাপতি নিয়ে চর্চা করে, তাদের পক্ষে জাগুলি একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এখানে অনেক রকমের প্রজাপতি পাওয়া যায়। সবাই জানে প্রজাপতি দেখার সময় হলো বর্ষার পর আর শীতের পর। অবশ্য সারা বছরই প্রজাপতি কমবেশি পাওয়া যায়। তবে এই দুটো সময়ে সবচে বেশি পাওয়া যায়।
পরের কোনো পর্বে নদিয়ার অন্য জায়গাগুলো নিয়ে বলবো।
(পর্ব ২)
বৈদ্যবাটি খালের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমার মনে পড়ে অজস্র প্রজাপতির কথা। একবার এখানে আমরা অন্তত ১৫টার মতো ব্লু প্যানজি আর দুটো ইয়েলো প্যানজি প্রজাপতি পেয়েছিলাম! পশ্চিমবঙ্গের রুখুশুখু এলাকাগুলো বাদে এই দুটো প্রজাপতি বড়ো একটা দেখতে পাওয়া যায় না।
এখানে আমরা একবার হোয়াইট টাইগার প্রজাপতিও পেয়েছি! খুব অবাক হয়ে গিসলাম। আর পেয়েছি কমোন অ্যালবাট্রস, ইন্ডিয়ান ক্যাবেজ হোয়াইট! হোয়াইট টাইগার আসলে সমুদ্রধারের প্রজাপতি।
কমোন অ্যালবাট্রস আর ইন্ডিয়ান ক্যাবেজ হোয়াইট দক্ষিণবঙ্গে তো বড়ো একটা দেখতেই পাই না। এরা আমাদের এখানে প্রধানত উত্তরবঙ্গের প্রজাপতি।
আর উল্লেখযোগ্য হলো শীতের পর, বর্ষার পর আমরা এখানে যে কোনো দিনই ৬-৭টা ফ্যালকেট ওকব্লু প্রজাপতি দেখতে পাই। যে গাছে এরা ডিম পাড়ে, সেই গাছ এখানে প্রচুর আছে। আমরা এই গাছটাকে বলি আকুস (ম্যালোটাস রিপ্যান্ডাস)। ডাল কেটে বসালেই হয়। ভারতবর্ষে ফ্যালকেট ওকব্লু চট করে দেখতে পাওয়া যায় না!
আর বৈদ্যবাটি খালে পাওয়া যায় প্রচুর ফড়িং। এখানে আমরা এসচুয়ারাইন স্কিমার পেয়েছি।
এটা আসলে আমাদের সমুদ্রের আশপাশের ফড়িং। এখানে আমরা প্রায়শই পাই কলিঙ্গ ফড়িং অর্থাৎ টাইনি হুডেড ডার্টলেট (অ্যাগ্রিয়োকনেমিস কলিঙ্গ)।
এটা পৃথিবীর সবচে ছোটো ফড়িং! দৈর্ঘ্য মাত্রই ৮-৯ মিলিমিটার!
অনেকেই জানে ফড়িং সবচে বেশি পাওয়া যায় জলের ওপর, জলের ধারে, জলের কাছে। জল থেকে যতো দূরে যাওয়া যাবে, ফড়িং ততোই কমে যাবে। অর্থাৎ কোথাও ফড়িং বেশি দেখা যাচ্ছে মানেই কাছাকাছি কোথাও জল আছে।
আর বর্ষাকালেই ফড়িং দেখা যায় সবচে বেশি। বর্ষাকালটাই ফড়িং চর্চার সবচে ভালো সময়, যদিও সারা বছরই আমরা কমবেশি ফড়িং দেখতে পাই।
সবাই জানে এই পাখি প্রজাপতি ফড়িং গাছপালা দেখতে বেরিয়ে আশ্চর্য সব মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, আলাপ হয়, ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতাও হয়, আমাদের অনেক কিছু প্রাপ্তি ঘটে। একদিন অর্ক সরকার ফোন করে বললো, “আপনারা তো রোববার রোববার পাখি দেখতে যান, কোনো বাচ্চা ছেলে আপনাদের সঙ্গে যেতে চাইলে নেবেন?”
আমি বললাম, “আগ্রহ থাকলেই হবে। বয়েস নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না।”
এইভাবে শুরু। সেটা ছিলো শীতের সময়। পরের রোববার মা সুদেষ্ণা বাগচির সঙ্গে বৈদ্যবাটি খালে আমাদের সঙ্গে সেই প্রথম পাখি দেখতে এলো মেঘ বাগচি! সালটা ছিলো ২০১৩। তখন ওর বয়েস মাত্রই সাত! তখনই সে স্থানীয় সব পাখিই চেনে, তাদের ডাক শুনে বলতে পারে কী পাখি! অনেক পরে আমরা জানলাম ওর ভালো নাম কৌশেয়!
আমাদের সঙ্গে যারা ফিল্ডে বেরোয়, এখন তারা সবাই মেঘ বাগচির ইন্টারেস্ট লেভেল, এনার্জি লেভেল, পাখি স্পট করার ক্ষমতা, আইডি করার দক্ষতা সম্পর্কে জানে। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ফিল্ডে থাকে। যেমন অতনু মোদক, যেমন বিশ্বনাথ মণ্ডল ফিল্ডে এলে আমরা অনেক বেশি পাখি দেখতে পাই, অনেক বেশি স্পিসিস দেখতে পাই, তেমনি মেঘ এলেও তাই হয়।
(পর্ব ৩)
সিকেবিএস-এ ঢুকে আমরা প্রথমেই খোঁজ করি ব্রাউন ফিশ আউল কোথায় আছে। সবাই ছবি তোলে। এখানে ব্রাউন ফিশ আউল আছে মোট চারটে।
পশ্চিমবঙ্গে এই পেঁচাটা অন্য কোথাও বড়ো একটা দেখতে পাওয়া যায় না! এখানে আমরা নিয়মিত ইন্ডিয়ান স্কপস আউল আর কলার্ড স্কপস আউলও পেয়েছি। এখানে এতো কিছু পেয়েছি, সব সময় মনে রাখা মুশকিল হয়!
এইমাত্র কৌশেয় বাগচি মনে করিয়ে দিল, তাই মনে পড়লো: অনির্বাণ পাল ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে একটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ভায়োলেট কুক্কুর অসামান্য ছবি তুলেছিলো! ভারতবর্ষে এটাই সবচে ছোটো কোকিল জাতীয় পাখি, দৈর্ঘ্য মাত্রই ১৭ সেন্টিমিটার! এই চলতি বছরেই কৌশেয় পেয়েছিলো লেসার ইয়েলোনেপ কাঠঠোকরা! এই দুটো পাখিই দক্ষিণবঙ্গে খুব দুর্লভ!
সিকেবিএস-এ আমরা দু’চারবার লিটল স্পাইডারহান্টার দেখেছি। এটা সিকেবিএস-এর লাগোয়া শ্যামখোলাতেও কয়েকবার দেখেছি, অনেকের কাছে চমৎকার ছবিও আছে। পাখিটা দক্ষিণবঙ্গে খুবই দুর্লভ! আমার মনে আছে এখানে একসময় নিয়মিত পেতাম জার্ডন’স লিফবার্ড, অ্যাবটস ব্যাবলার। জার্ডন’স লিফবার্ড তো এখানে বাসা করতো। আমরা দেখেছি বাচ্চাকে বড়ো পাখি দুটো খাওয়াচ্ছে। সিকেবিএস-এ একবার আমরা হোয়াইট-আইড বাজার্ড দেখেছি, মাথার ওপরে ঘুরতে ঘুরতে উড়ছিলো। মনে আছে কুশল মুখার্জি আইডি করেছিলেন।কলকাতা শহতলিতে এইসব পাখি বড়ো একটা পাওয়াই যায় না।
এখানে অনেক হোয়াইট-থ্রোটেড ফ্যানটেল আছে, অন্তত পনেরোটা তো বটেই! খুব চঞ্চল পাখি, চট করে ছবি তোলা যায় না! এখানে আমরা একবার থিক-বিলড ফ্লাওয়ারপেকার পেয়েছি। বেশ কয়েকবার স্কারলেট-ব্যাকড ফ্লাওয়ারপেকারও পেয়েছি, অনেকেই ছবি পেয়েছে। একসময় তো নিয়মিত ইন্ডিয়ান পিট্টা, কমোন উডশ্রাইক, স্মল মিনিভেটও পেয়েছি।
বলতে ভুলে গিসলাম, অনিরুদ্ধ রায় মনে করিয়ে দিলো তাই! এখানে আমরা এখনও নিয়মিত স্লেটি-লেগড ক্রেক পাই, মোট অন্তত চারটে আছে। ভেতরে ঢুকেই বাঁদিকে একটা টিউবওয়েল আছে, ওখানে আমরা নিচের বাঁধানো জায়গাটার মুখ মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে জল জমিয়ে রাখতাম, সব পাখি এসে জল খেতো, চান করতো। স্লেটি-লেগড ক্রেকও আসতো। সবাই ছবি তুলতো। এই পাখিটা পশ্চিমবঙ্গে খুব কমই পাওয়া যায়! আর একবার, শীত শেষ হয়ে গেছে, খুব গরম সেদিন, ঠিক ঐখানেই, ওই কলের আশপাশে, কলের নিচে পেয়েছিলাম আইব্রোড থ্রাশ! কলকাতায় এবং শহরতলিতে ওটাই ছিল ফার্স্ট সাইটিং! আমরা তখন খুব, যাকে বলে, থ্রিলড হয়েছিলাম! অনেকেই তখন ছবি তুলেছিলো।
অতনু মোদক একটু আগে একটা অনবদ্য পাখির কথা মনে করিয়ে দিলো। শান্তনু চ্যাটার্জি এখানে ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারিতে ইউরেশিয়ান উডকক-এর ভালো ছবি তুলেছিলো। পাখিটা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গেই অত্যন্ত দুর্লভ!
অনীশ বেরা আরো একটা পাখির কথা মনে করিয়ে দিলো।এমারেল্ড ডাভ। এটাও এখানে এখনও মাঝে সাঝে দেখা যায়। খুব নীরব পাখি, খুব শান্ত! সামনেই মাটিতে ঘুরছে, অথচ চট করে দেখা যাচ্ছে না, এমনই সবুজ!
আরেকবার আমরা একটা চিকন গাছে (ট্রেমা ওরিয়েন্টালিস) চারটে অরেঞ্জ-ব্রেস্টেড গ্রিন পিজিয়ন পেয়েছিলাম, দারুণ দেখতে, চিকনের ছোটো ছোটো ফলগুলো খাচ্ছিলো। এবার একটা খুব দুঃখের কথা বলি। এখানে একসময় লার্জ ইন্ডিয়ান সিভেটও পাওয়া যেতো। ১৯৯৬ সালে আদিবাসীরা একটাকে মেরে বাঁশে বেঁধে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিলো। খবর পেয়ে অসিত ব্যানার্জির ছেলে আনন্দ ব্যানার্জি এসে ছবি তুলে রাখে।
আনন্দরা কাছেই থাকে, শ্যামখোলায়। কৌশিক দেউটি এটা নিয়ে একটা ভালো লেখা লিখেছিলো। সেই লেখার সঙ্গে এই ছবিটাও ১৯৯৬ সালেই স্যাংচুয়ারি এশিয়া পত্রিকায় বেরিয়েছিলো। ওই সংখ্যাটা আমি দেখেছি, ওই লেখাটা দেখেছি, কৌশিক দেউটি আমাকে দেখিয়েছিলো। তখন স্যাংচুয়ারি এশিয়ার সাইজ ছিলো অনেকটা ছোটো, এখনকার মতো এতো বড়ো, এতো চওড়া ছিলো না। পরে জেনেছি এটাই ছিলো এখানকার শেষ লার্জ ইন্ডিয়ান সিভেট!
একবার বন দপ্তর আর অর্জন বসুরায়ের ব্যবস্থাপনায় অনির্বাণ চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা সন্ধ্যে থেকে সকাল পর্যন্ত এখানকার নিশাচর প্রাণীদের পর্যবেক্ষণ করছিলাম। সেই সময় এমন বড়ো একটা কমোন ক্রেট দেখেছিলাম! কী তার রূপ! কী চাকচিক্য! আমি কোনোদিন এরকম বড়ো কমোন ক্রেট দেখি নি! অনির্বাণ চমৎকার ছবিও তুলেছে। এখন আর এসব কিছু আছে কিনা জানি না। কেননা, হাইওয়ে কানেকটার রোড করার জন্যে সরকার বাঁদিকের জলাশায়টা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে, একশোটার মতো গাছ আর প্রচুর ঝোপঝাড় কেটে ফেলেছে!
আরো দুটো উল্লেখ্যযোগ্য কথা বলতে ভুলে গেছি।
এক : আমরা সেদিন বাঁদিকে জলের ধারে বসেছিলাম।
আমি একটা খুব ছোট্ট ফড়িং দেখতে পেলাম, হালকা হলদে রঙের, একটু যেন সবুজ আভা আছে। এতো ছোট্ট ফড়িং আগে কখনও দেখি নি! প্রসেনজিৎ দাঁ পাশেই ছিলো, ওকে দেখালাম। ও তো ফড়িং নিয়ে খুব চর্চা করে, ছবি তুলে রাখলো। এক্ষুনি প্রসেনজিৎ জানালো, এটা ২০১০ সালের কথা। অনেক পরে জানলাম এটা একেবারে একটা নতুন ফড়িং, আমরা যাকে বলি নিউ টু সায়েন্স। আগে কোথাও এর কোনো রেকর্ডই নেই, কেউ ডেসক্রাইব-ই করে নি! এমনকি ত্রিদিব মিত্রর ফড়িং নিয়ে ওই বিপুল চর্চা, ওই অতো লেখালিখির মধ্যে কোথাও এর উল্লেখ নেই! ২০১৫ সালে যৌথভাবে মনোজ ভি. নায়ার এবং কে. এ. সুব্রামানিয়ান প্রথম এটা ডেসক্রাইব করেন, নাম দেন টাইনি হুডেড ডার্টলেট (অ্যাগ্রিয়োকনেমিস কলিঙ্গ)। আমরা বলি কলিঙ্গ ফড়িং।তখনই জানলাম এটা পৃথিবীর সবচে ছোটো ফড়িং! দৈর্ঘ্য মাত্রই ৮-৯ মিলিমিটার!
দুই : আমরা সেই সময় মাঝে মাঝেই সিকেবিএস-এ যাই। কমোন ব্যান্ডেড পিকক প্রজাপতি দেখতে পাই, তার রূপে মুগ্ধ হয়ে যাই। যারা দেখেছে তারা সবাই জানে, কী আশ্চর্য এর রঙের বাহার। ওখানে আমি আরো একটা প্রজাপতি দেখতে পাই, যেটা আগে কখনও কোথাও দেখি নি, কেউ দ্যাখে নি। মালাবার ব্যান্ডেড পিকক-এর মতো দেখতে। এটা এখানে পাবার কথাই নয়, এটা সম্পূর্ণ দক্ষিণ ভারতের প্রজাপতি। অবশেষে অর্জন বসুরায় ছবি তুলে প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ ক্রুষ্ণামেঘ কুন্টে-কে পাঠায়। উনি আইডি করে বলেন, এটা গ্রিন ব্যান্ডেড পিকক, ভারতবর্ষে এই প্রথম রেকর্ড হলো! উনি এর ওপর পেপারও প্রকাশ করেন। নিয়ম মতো তাতে আমার নাম, অর্জনের নামও ছিল, দেখেছি।
আরো একটা কথা মনে পড়লো: সৌম্যজিৎ চৌধুরী এখানেই প্রথম ফ্যালকেট ওকব্লু আর ব্যানানা রেড-আই অর্থাৎ ব্যানানা স্কিপার প্রজাপতি দ্যাখে, ছবি তোলে, পরে আইডি করে আমাদের জানায়। মনে রাখতে হবে সেই সময় কিন্তু প্রজাপতির এতো বই ছিলো না, এখনকার মতো নেট ওয়ার্কের এতো সুবিধে ছিলো না।
আমরা এই প্রজাপতি দুটো এর আগে কোথাও দেখি নি।
আর একটা কথা মনে পড়ছে।
তরুণ প্রকৃতি চর্চাকারী অনিমেষ মান্নার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এখানেই। শিবপুর বি. ই. কলেজের অধ্যাপক দেবাশিস গাঙ্গুলি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন, আমাকে বলেন, “একে আপনার কাছে নাড়া বেঁধে দিলাম।” আমি খুব হতবাক হয়ে গিসলাম। নাড়া! নাড়া বাঁধা! এ তো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পরিভাষা! অনিমেষের কিন্তু তখন নাড়া বাঁধার কিছু ছিলো না। ও আমাদের কাছে এসেছিলো একেবারে তৈরি হয়েই। অনিমেষ জানালো সেটা ছিলো ২০১০ সালের এপ্রিল মাস। অনিমেষ এখন সাতপুরা ফরেস্টে ন্যাচারালিস্টের কাজ করে। শুনেছি ওখানে ওর খুব নামডাক। তার আগে কয়েক বছর ছিলো পেঞ্চ ফরেস্টে।
তারও আগে কয়েক বছর সুন্দরবনে। তার মানে ওর বিপুল ফিল্ড অভিজ্ঞতা, বিপুল পর্যবেক্ষণ!
এখন সিকেবিএস-এর কী অবস্থা জানি না, কী কী পাওয়া যায়, তাও জানি না। করোনা পরিস্থিতির জন্যে অনেকদিন ওখানে আমার যাওয়াই হয় নি!
(পর্ব ৪)
আমার ধারণা এই পর্বটা অনেকেই পড়বে না, তবু মনে হয় এগুলোও আমার লেখা দরকার।
ছেলেবেলা থেকেই আমার এটা ওটা দেখার, ধরার খুব ঝোঁক ছিলো। এটা ওটা বলতে পোকা-মাকড়, ফড়িং পিঁপড়ে প্রজাপতি, পাখি, এমনকি সাপ ব্যাং মাছ…সব, সামনে যখন যা পেতাম। এদের নড়া চড়া চলা ফেরা হাঁটা ওড়া বসা দেখতাম, ছেলেবেলায় এদের বিষয়ে বিশেষ কিছুই জানতাম না, ফলে ধরতে গিয়ে অনেক সময় বেশ বিপদে পড়তাম!
আমাদের বাড়ি বালিতে। বাড়ির সামনে কারখানার মাঠ, এখানে একসময় বেতের ঝোড়া তৈরির কারখানা ছিলো। খুব ছেলেবেলায় এই মাঠই ছিলো আমার সারাদিন ঘোরাফেরার জায়গা, পাখি, প্রজাপতি, ফড়িং, গাছপালা এইসব দেখার জায়গা।
এর গায়েই একটা বিশাল শিমুল গাছ ছিলো, শিমুল ঢেঁড়ি পেকে, ফেটে তুলো উড়ে যেত, অনেক তুলো নিচেও পড়তো, ওতে লাল লাল পোকা হতো। পুরো লাল নয়, লালে কালোয় মেশানো, তবে কালো কম। আমরা একে বলতাম তুলো পোকা। এই তুলো পোকা ধরে হরলিক্সের শিশিতে, কাঁচের বয়ামে রাখতাম। শিশির ঢাকনায় ছোটো ছোটো ফুটো করে দিতাম, বয়ামের মুখে পুরনো কাপড়ের টুকরো বেঁধে দিতাম। ভেতরে গাছের শুকনো কাঠি তেরছা করে এমনভাবে রেখে দিতাম যাতে ওরা ওঠা নামা করতে পারে। সারাদিন ধরে এই ওঠা নামা দেখতাম। খেতে দিতাম বীজসুদ্দু শিমুল তুলো। খেতো কিনা ঠিক বুঝতে পারতাম না। ডিম ফুটে মাঠের যেখানে এদের বাচ্চা হতো সেখানটা একেবারে লাল হয়ে থাকতো। ঠিক লাল নয়, লালচে কমলা। বাচ্চাগুলো অনেকটাই গোলগোল দেখতে। যারা দেখেছে, তারা জানে।
অনেক, অনেক পরে জেনেছি পতঙ্গের এই দশাটাকে বলে নিম্ফ। এবং অনেক, অনেক পরে জেনেছি একে বলে রেড কটন বাগ (ডিসডেরকাস সিঙ্গুল্যাটাস)।
আরেকটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের বাড়িটা একটা গলির ভেতর, রাস্তা মাত্র চার ফুট চওড়া। বাড়ির উল্টোদিকেই একটা পুকুর। একদিন বিকেলের দিকে আমি আর প্রভাত এখানে কাঁকড়া ধরছি, একেবারে অন্ধকার করে খুব মেঘ করেছে।
পুকুরের ওপারে ডানদিক ঘেঁষে একটা খুব পুরোনো গাব গাছ, খুব ঝোপঝাড়। দেখলাম ওখান থেকে একটা বেঁজি বেরিয়ে এলো। বেঁজিও কাঁকড়া ধরে খায় দেখেছি। বেঁজিটা দেখলাম জলের ধারে এসে ঘুরঘুর করে জলে নেমে গেল! আমি আর প্রভাত তো হতভম্ব! বেঁজি জলের ভেতর ঢুকে গেল! পাশেই থাকেন নারানদা, উনি তখন বেরোচ্ছিলেন, বললেন, ওটা বেঁজি নয়, ভোঁদড়।
আমার বয়স তখন সাত-আট হবে। অর্থাৎ ৬৫-৬৬ বছর আগের কথা! ঘটনাচক্রে এখন আমার বয়েস ৭৩! এবং খুবই দুঃখের কথা, এই নীরব প্রাণীটা অতি নীরবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে! এখন মাঝে মধ্যে যেটুকু দেখতে পাওয়া যায়, তাও বেশির ভাগই শুধু সুন্দরবন থেকে।
ওই গাব গাছের ওখানে ঝোপঝাড়ে শেয়াল, বন বিড়াল, মেছো বিড়াল, তক্ষক, গোখরো সাপ, কেউটে সাপও পাওয়া যেতো, আমিও দেখেছি!
সবাই জানে পুরনো বাড়ির দেয়ালে এক ধরনের খুব বড়ো মাকড়সা দ্যাখা যায়, লম্বা লম্বা পা, দেয়ালে একেবারে সেঁটে বসে থাকে, ডিমের পুঁটলিটা শরীরের নিচে থাকে! খুবই আশ্চর্যের, ওই পুঁটলিটা মুখে করে নিয়ে শরীরের নিচে রেখেই ঘোরাফেরা করে দেখেছি! একদিন ডান হাতটা বাটির মতো করে আচমকা ওকে ধরেছি, আর সঙ্গে সঙ্গে উঃ বলে তক্ষুনি মাকড়সাটাকে ছেড়ে দিয়েছি। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যে বুড়ো আঙুলটা
যাকে বলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেল! অনেক, অনেক পরে জেনেছি এর নাম জায়ান্ট ক্র্যাব স্পাইডার (হেটেরোপোডা ভেনাটোরিয়া)। মাকড়সা বিশেষজ্ঞ সুমিত চক্রবর্তী এর নাম দিয়েছেন বড়ো কাঁকড়া মাকড়সা। আর একবার, ১৯৭৩ সালে বর্ষার সময়, আমাদের গ্রামে, পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর এলাকায় হাত চাপা দিয়ে
একটা ছোটো পোকা ধরেছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে হাতটা যেন পুড়ে গেল, যেন ছ্যাঁকা লেগে গেল! আমার মেজো জেঠিমা বলেছিলো, “ওটাকে তো আমরা ছ্যাঁক পোকা বলি রে! তুই ধরতে গেলি কেন!”
ওপারের লোকেরা বলে গরম পোকা! ওপারে বলতে আমাদের গ্রামে কাঁসাই নদীর ওপারে। আমাদের ভিটের ঠিক গায়েই কাঁসাই নদী। হ্যাঁ, মনে হয়েছিলো পোকাটা যেন গরম হাওয়া ছাড়লো, হাতে ছ্যাঁকা লেগে গেল যেন! ওই পোকাটা সম্পর্কে এখনো কিছু জানতে পারি নি। তবে ওটা ব্লিস্টার বিটল নয়। ব্লিস্টার বিটল তো আকন্দ গাছে থাকে, আকন্দ পাতা খেয়ে খেয়ে শেষ করে দেয়, ধরলে খুব ছ্যাঁকার মতো লাগে, ফোস্কা পড়ে যায়। এই জন্যেই তো ওর এরকম নাম। এটা কোনোদিন খালি হাতে ধরি নি।
এক সময় আমার খুব সাপ পোষার ঝোঁক ছিলো। বড়দা আমাকে একদিন বললো, “তুই যে ঘরে সাপ রাখছিস…”
আমি বললাম, “ওগুলো তো নির্বিষ সাপ।”
“সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু কোনোটা যদি তোর ওখান থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে ঢুকে পড়ে, অন্যরা তো আতঙ্কে, ভয়ে হার্ট ফেলও করতে পারে!”
“হ্যাঁ, সেটা হতে পারে।”
তারপর থেকে আমি আর বাড়িতে সাপ রাখি না।
কিন্তু তখন আমি সাধারণত যেসব সাপ রাখতাম, সেগুলো হলো বেত আছড়া, খড়িচূর, ঘরচিতি, লাউডগা, কালনাগিনী, কখনো সখনো হেলে, এমনকি জলঢোঁড়াও। সবাই জানে এগুলো সবই নির্বিষ বা ক্ষীণবিষ সাপ, ক্ষতিকারক নয়।
আমাদের এখানে একজন বাউল থাকেন, নাম হারাধন দাস বাউল। তিনি আমাকে একটা আশ্চর্য কথা বলেছিলেন, ”দেখুন, পাত্রদা, ভয়েরও তো একটা বিষ আছে!”
মনে পড়ছে, একবার তাঁর টালির বাড়িতে টালির ফাঁকে অনেকগুলো বেত আছড়ার বাচ্চা দেখা গিসলো, তখন তিনি আমাকে ডেকেছিলেন ওগুলো কী সাপ জানার জন্যে, আসলে বিষধর কিনা জানার জন্যে।
আমি বলেছিলাম, “ভয়ের কিছু নেই, ওগুলো নির্বিষ সাপ, ক’দিন পরে একটু বড়ো হলেই চলে যাবে।”
তিন চার দিন পরে গিয়ে দেখি ঘরামি ডেকে উনি সব টালি খুলে ফেলছেন।
আমি বললাম, “কী হলো! টালি খুলে ফেলছেন কেন?”
তখনই তিনি আমাকে ওই মোক্ষম কথাটা বলেছিলেন, “ক’দিন আমরা কেউ ভয়ে-আতঙ্কে ঘুমোতে পারিনি!
দেখুন, আপনি বলছেন এই সাপের বিষ নেই, কিন্তু ভয়েরও তো একটা বিষ আছে!”
আমি তখন আর তাঁকে কিছুই বলতে পারি নি।
আমাকে সাপ কামড়েছে মোট তিনবার। তার মধ্যে একবার, একেবারে শেষের বার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিলো! সেটা ১৯৭৫ সালের ঘটনা। এই লেখাটা অনেক বড়ো হয়ে যাচ্ছে! আরেক দিন বলবো।
(পর্ব ৫)
আমার প্রথম ওয়াইল্ডলাইফ হলো পিঁপড়ে! এরকম হয়তো আরো অনেকেরই। একটা ঘটনা বলবো, পড়তে হয়তো ততো ভালো লাগবে না, একঘেঁয়ে লাগতে পারে, তবে খুবই ইন্টারেস্টিং! আমাদের পুরোনো বাড়ি, কাঠের চৌকাঠ, দু-এক জায়গায় ফেটে ফুটে গেছে, ফুটো হয়ে গেছে, সেসব জায়গায় আমার পিঁপড়েরা থাকে। যে পিঁপড়েগুলোকে আমি খুব দেখতাম, লক্ষ্য রাখতাম, সেগুলো গাঢ় বাদামি রঙের, সুড়সুড়ি পিঁপড়ের চে সামান্য ছোটো, তবে সুড়সুড়ি পিঁপড়ের মতো অতো তড়বড়ে নয়, পাগুলোও অতো লম্বা লম্বা নয়।
এদের ইংরিজি নাম, বৈজ্ঞানিক নাম এখনও জানতে পারিনি। আমি বলি বাদামি পিঁপড়ে।
এরকম একটা বাদামি পিঁপড়ে যখন কোনো খাবার নিয়ে যাবার চেষ্টা করতো, ধরা যাক মরা ছোটো আরশোলা, তখন আমি ওই আরশোলাটার একটা পা আঙুল দিয়ে চেপে রাখতাম, পিঁপড়েটা আর খাবারটাকে নিয়ে যেতে পারতো না, কিছুক্ষণ টানাটানি করে ছেড়ে দিয়ে বাসায় যেতো খবর দিতে। তখন তার চলাটা হতো অন্যরকম, একটু ফাস্ট, একটু কেঁপে কেঁপে যেন ছুটছে! আমি খুব আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, ওই পিঁপড়েটা বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই হুড়হুড় করে অনেক পিঁপড়ে বেরিয়ে আসতো এবং সারি দিয়ে একেবারে নির্ভুলভাবে ওই একই পথে ওই খাবারটার দিকে যেন দৌড়োতো, গতিটা একটু বেশিই, একটু চঞ্চল! আমি সেই সময় ভাবতাম ওই পিঁপড়েটা নিশ্চয়ই ওই লাইনের প্রথমেই থাকে, অন্যদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু নানা কারণে আমার সন্দেহ হলো। তখন আমি করলাম কী, আমি নিজেই একটা মাছি মেরে ওরকম একটা পিঁপড়ের সামনে মাছিটা দিলাম আর মাছিটার একটা পা চেপে ধরে রাখলাম।
একটু পরে পিঁপড়েটা চললো বাসায় খবর দিতে। তখন আমি ওই পিঁপড়েটার ওপর খুব আলতো করে খুব সামান্য ময়দা ছড়িয়ে চিহ্ন দিয়ে দিলাম। দেখলাম, বাসা থেকে সারি দিয়ে পিঁপড়েরা বেরোচ্ছে, এবং তখন, না, ওই পিঁপড়েটা সারির সামনে নেই! আমার তখন মনে হলো, ও নি়শ্চই কিছু একটা ছড়াতে ছড়াতে বাসায় ফিরেছে। আমি করলাম কী, একটু দূরে ওই পথটা আঙুল দিয়ে কেটে দিলাম, সঙ্গে সঙ্গে পিঁপড়েগুলো এলোমেলো হয়ে গেল, আর পথ খুঁজে পেলো না! আমি সেই সময় ফেরোমোন বিষয়ে কিছুই জানতাম না, নামই শুনিনি!
অনেক, অনেক পরে জেনেছি পিঁপড়েটা ফেরোমোন ছড়াতে ছড়াতে বাসায় যেতো! আর সেই ফেরোমোনের গন্ধ শুঁকে শুঁকে অন্য পিঁপড়েরা সঠিক পথে গন্তব্যে চলে যেতো, কেউ পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতো না!
প্রখ্যাত লেখক এবং কীটপতঙ্গ চর্চাকারী যুধাজিৎ দাশগুপ্ত একবার আমায় বলেছিলো, “পতঙ্গদের ঘ্রাণশক্তি খুব প্রখর, ওরা খুব ঘ্রাণ নির্ভর।”
আমাদের বাড়িতে দুটো পিয়ারা গাছ ছিল, ওখানে অনেক কাঠপিঁপড়ে ছিলো। একটু উঠোন ছিলো, একটু মাটি ছিলো, এখনও আ়ছে, ওখানে মেঠো ডেঁও পিঁপড়ে ছিলো। আমি আমাদের বাড়িতে মোট আট রকমের পিঁপড়ে দেখতে পেতাম!
১। ওই গাঢ় বাদামি রঙের পিঁপড়েটা, যার ইংরিজি নাম, বৈজ্ঞানিক নাম এখনও জানতে পারি নি আগেই বলেছি।
২। সুড়সুড়ি পিঁপড়ে: ব্ল্যাক ক্রেজি অ্যান্ট (প্যারাট্রেচিনা লঙ্গিকর্নিস)।
৩। ছোটো লাল পিঁপড়ে বা লাল গুঁড়ি পিঁপড়ে: ফারাও অ্যান্ট (মোনোমোরিয়াম ফারাওনিস)।
৪। বড়ো লাল পিঁপড়ে: ট্রপিকাল ফায়ার অ্যান্ট (সোলেনোপসিস জেমিনাটা)।
৫। গন্ধি পিঁপড়ে: ঘোস্ট অ্যান্ট (ট্যাপিনোমা মেলানোসেফালাম)।
৬। কাঠপিঁপড়ে: বাইকালার্ড আর্বোরিয়াল অ্যান্ট (টেট্রাপোনেরা রুফোনিগ্রা)।
৭। ডেঁও পিঁপড়ে: ইন্ডিয়ান ব্ল্যাক অ্যান্ট (ক্যাম্পোনোটাস কম্রেসাস) এবং
৮। মেঠো ডেঁও পিঁপড়ে: গোল্ডেন-ব্ল্যাকড অ্যান্ট (ক্যাম্পোনোটাস সেরিসেউস)।
আরেকটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। তখন মাঝে সাঝে আমরা বাস থেকে বালি জয়পুর বিলে নেমে রেল লাইন ধরে ঘুঘুপাড়া ভেড়িতে যেতাম। এই লাইনে লোকাল ট্রেন যেতো না, ক্বচিৎ কখনো দুয়েকটা মাল গাড়ি যেতো। খানিকটা যাবার পর আমরা বাঁদিকে জলের ধারে নেবে এরকম যেতে যেতে একবার একটা ফড়িং দেখতে পেয়েছিলাম, যেটা আমরা চিনি না। মনে রাখতে হবে, তখন ফড়িং-এর তেমন কোনো বই ছিলো না, ইন্টারনেট পরিষেবাও এখনকার মতো এতো সুলভ ছিলো না। অর্ক সরকার সেদিন আমাদের সঙ্গে ছিলো, বললো,
“দাঁড়ান, আমি ছবি তুলতে পেরেছি, এক্সপার্টদের কাছে পাঠিয়েছি, এক্ষুনি নামটা বলে দিচ্ছি।”
অর্ক বিশিষ্ট পাখি বিশেষজ্ঞ হলেও ফড়িং নিয়েও ভালো চর্চা করে। হ্যাঁ, অর্ক একটু পরে ফড়িং-এর নামটা বলেও দিলো। তখন দেখলাম, অর্কর হাতে বেশ একটা বড়ো ফোন, এখন আমরা যাকে স্মার্ট ফোন বা টাচ ফোন বলি। ওরকম অতো বড়ো ফোন আগে কখনও দেখি নি!
ওটা কী ফড়িং ছিলো, আমার এখন আর মনে নেই। যতদূর সম্ভব সালটা ছিলো ২০০৭ কী ৮।
অর্ক ফড়িংটার নাম আর সালটা বলতে পারবে। সেদিন আমরা খুব হতবাক হয়ে গিসলাম! এই ক’বছরে প্রযুক্তি কোথায় গেছে!
ফিল্ড থেকেই প্রায় তক্ষুনি তক্ষুনি আইডি হয়ে যাচ্ছে! (এইমাত্র অর্ক জানালো: অনেকদিন আগেকার কথা, সালটা ২০০৮ হতে পারে আর ফড়িংটা হয়তো বা ছিলো ব্র্যাচিডাইপ্ল্যাক্স চ্যালাইবিয়া)।
অনেক ধন্যবাদ অর্ক।
মনে রাখতে হবে, ত্রিদিব মিত্রের কমোন ইন্ডিয়ান ড্রাগনফ্লাইজ বইটা বেরিয়েছিলো ২০০৬ সালে এবং তখনও আমাদের হাতে আসে নি। তাছাড়া এই বইয়ে কমোন নাম নেই, সবই বৈজ্ঞানিক নাম। এখন কে. এ. সুব্রামানিয়ানের ফড়িং-এর বই থেকে আমরা জানতে পেরেছি এই ফড়িংটার নাম রুফাস-ব্যাকড মার্শ হক।
আমাকে সাপে কামড়ানোর কথাটা এবারে বলি। আমাকে সাপে কামড়েছিলো মোট তিনবার। এর মধ্যে শেষের বার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিলো। সেটা ১৯৭৫ সালের ঘটনা। রোজ সন্ধ্যেবেলা আমরা যেমন কয়েকজন বন্ধু উত্তরপাড়া লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে থাকি, সেদিন সেরকমই আছি, নানান রকম গল্প করছি, সেইসব কথাবার্তা মূলত সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রিক।
এমন সময় সেদিন একজন খুব চেনা ছেলে এসে বললো, “পাত্রদা, আমাদের বাড়িতে একটা সাপ বেরিয়েছে, সবাই ভয় পেয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আপনি এক্ষুনি একবার চলুন, যদি সাপটাকে ধরে বাইরে আনতে পারেন।”
ওরা জানে, আমি মাঝে মধ্যে সাপটাপ ধরি। ওদের বাড়িতে গেলাম। ওখানে আমুলের একটা কৌটো পেলাম। একটা ছোটো লাঠি আর ওই কৌটোটা দিয়ে সাপটাকে কায়দা করে ধরে বের করে আনলাম। অন্ধকার বলে তখন সাপটাকে ভালো করে দেখতে পাই নি, কী সাপ তখনও জানি না। লাইব্রেরিতে এসে লাইব্রেরির চাতালে বসে কৌটো থেকে সাপটাকে বের করে ভালো করে দেখলাম। ওখানে টিউবলাইটের আলো ছিলো। দেখলাম এটা কালাজ! অন্তত সেরকমই দেখতে। কালো রং, কিছুদূর অন্তর সরু সাদা সাদা রিং!
কৌটো থেকে বের করে বন্ধুদের বারবার দেখাতে গিয়ে আমারই মুহূর্তের অসাবধানতায় আমাকে কামড়ে দিলো! ডান হাতের তর্জনীর প্রায় ডগার কাছে। দেখলাম দুটো দাঁতের দাগ! তার মানে বিষধর সাপ! আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে যথাস্থানে বাঁধন দিয়ে কাছেই উত্তরপাড়া হাসপাতালে চলে গেলাম। সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুও এলো। সাপটা দেড় হাতের মতো লম্বা। সরু।
আমার সঙ্গে কিন্তু সাপ সুদ্দু কৌটোটা আছে। পেরেক দিয়ে কৌটোর ঢাকনায় তিন-চারটে ফুটো করে দিয়েছিলাম।
হাসপাতালের একজন জিজ্ঞেস করলো, “কী সাপ?”
বললাম, “সাপটা এই কৌটোয় আছে, দেখাচ্ছি।” বলে যেমনি ঢাকনা খুলে দেখাতে গেছি, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে সবাই ছিটকে দূরে সরে গেল! অবশেষে ডাক্তার বাবু এলেন, আমাকে ভর্তি করার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে বললেন, “আপনার সঙ্গে সাপটা থাকবে বলছেন, আপনাকে তাই এই দরজার কাছে মাটিতেই থাকতে হবে। ওরা বিছানার ব্যবস্থা করে দেবে।”
সেই সময় মাল্টি অ্যান্টিভেনাম তৈরি হয়নি। তখন সাপ অনুযায়ী চিকিৎসা হতো। তাই এখানে যদি আমার চিকিৎসা ঠিক মতো না হয়, তাহলে তো আমাকে কলকাতার হাসপাতালে যেতে হবে, সাপটাকে তো দেখাতে হবে, তাই কৌটোটা সঙ্গেই রেখেছি।
যাই হোক, সারা রাত ধরে মাঝে মাঝে ডাক্তার বাবু আমাকে এসে দেখে গেলেন।
আমার শারীরিক অবস্থার কোনো অবনতি হয়নি। তাও ডাক্তার বাবু আরো দু’দিন পর্যবেক্ষণে রাখতে চাইলেন, আমি আর থাকতে চাইলাম না। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী আমি এবং আরো দু’জন বন্ডে সই করে পরদিন সকালে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। খবর পেয়ে সকাল থেকেই বন্ধুরা সব আমাকে দেখতে এসেছে।
স্বভাবতই মানসিকভাবে আমার খুব ধকল গেছে, শরীরটাও কিছুটা কাহিল লাগছিলো। আমার একজন জুনিয়ার বন্ধু তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় বললো, “শুভঙ্করদা, একদম কোনো চিন্তা করবেন না। ভেবে দেখুন, আপনার আত্মজীবনীর একটা পাতা তো হয়ে রইলো!”
শুনে আমি সুদ্দু সবাই তো হো হো করে হেসে উঠলাম!
আমাদের বাড়িটা ছিলো প্রায় একটা ছোটোখাটো চিঁড়িয়াখানার মতো!
আমি যখন বড়ো হচ্ছি, আমার যখন জ্ঞান হচ্ছে, তখন, মনে আছে, আমাদের বাড়িতে অনেক ধরনের পাখি ছিলো! হলদে ঝুঁটিওলা একটা কাকাতুয়া ছিলো (লেসার সালফার ক্রেস্টেড), ময়না ছিলো, টিয়া, চন্দনা, মদনা, ফুলটুসি এইসব। এছাড়াও আমি যখন বড়ো হচ্ছি, আমিও নানান রকম পাখি পুষছি। বুলবুলি, সিপাই বুলবুলি, কোকিল, দোয়েল। দোয়েল পাখির খাবার জোগাড় করা ছিলো খুব মুশকিলের। দোয়েল তো আর ছাতু, ভাত, মুড়ি, ফলমূল এসব খায় না। দোয়েল হলো সম্পূর্ণ পতঙ্গভুক। ওর জন্যে বাজার থেকে পিঁপড়ের ডিম কিনে আনতে হতো, বন বাদড় থেকে উই পোকা, পিঁপড়ে, অন্যান্য পোকামাকড় ধরে আনতে হতো।
মনে রাখতে হবে সেই সময় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন এখনকার মতো এরকম এতো কড়া ছিলো না!
একবার বাসা থেকে একটা বুলবুলির বাচ্চা পড়ে গিসলো, সেটাকে আমি ছাতু ভাত মুড়ি পাকা আম কলা পোকা মাকড় এইসব খাইয়ে বড়ো করেছিলাম। বড়ো হয়েও সে আর কোথাও যেতে চাইতো না, সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকতো, হাতে কাঁধে মাথায় বসে থাকতো।
এরকমই বাচ্চা একটা হাঁড়িচাঁচা পাখি ঝড়ে পাশের বাড়ির আমগাছ থেকে পড়ে গিসলো। সেটাকেও খাইয়ে দাইয়ে বড়ো করেছিলাম, সেটাও ছেড়ে দিলে কোথাও যেতো না, আশপাশে ঘোরাঘুরি করতো, খেতো কিন্তু বাড়িতেই!
একটা কাঠবিড়ালি আমাদের ভেন্টিলেটারে বাসা করেছিলো। তার বাচ্চাটা পড়ে গিসলো। দুধ চাল বাটা ডাল বাটা খাইয়ে বড়ো করলাম, সেও আর কোথাও যায় না, আমাদের সঙ্গেই থাকে।
এইভাবেই আমাদের বাড়িটা হয়ে উঠেছিলো একটা ছোটো খাটো চিঁড়িয়াখানার মতো। এছাড়াও আমার ছিলো নানা রকমের মাছ, অনেক খরগোশ, অনেক সাদা ইঁদুর, অনেক রকমের পায়রা। সেসব কথা আবার পরে বলবো।
এবার অন্য একটা কথা বলি। এখন রোজই তো বৃষ্টি হচ্ছে!
আজ ১৯.৯.২১ তারিখ সকালে বৃষ্টি হচ্ছিলো না বলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলাম। রামনবমীতলা দিয়ে গজেন ঘোষের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। দেখলাম, লাইট পোস্ট বেয়ে, লাইটের তার বেয়ে উঠে গেছে চমৎকার একটা লতাগুলঞ্চ গাছ (টিনোস্পোরা কর্ডিফোলিয়া)।
বর্ষাকাল তো! গাছটা একেবারে ঝকঝক করছে! আর যেটা বলবার, সেটা হলো, খুব ফুল এসে গেছে! ছোটো ছোটো নাকছাবির মতো অজস্র ফুল, একটু সবুজ ঘেঁষা হালকা হলুদ রঙের ফুলগুলো, সেগুন ফুলের চেও ছোটো, নিচে ঝরে পড়ে আছে, কী তার রূপ! একটু পরেই একটা তেঁতুল গাছ। দেখলাম, তার গায়ে বসে আছে
একেবারে ফ্রেশ একটা ব্ল্যাক রাজা প্রজাপতি! এরও তো অসাধারণ রূপ! এইসব রূপের কাছে আনকোরা নতুন দশ হাজার টাকার নোটের রূপও একেবারে ম্যাড়মেড়ে মনে হয়! এইখানে বলে রাখি তেঁতুল গাছে ব্ল্যাক রাজা ডিম পাড়ে।
এবার থামতেই হবে, লেখাটা সত্যিই খুব বেড়ে যাচ্ছে!