সেই কবিতাই সৎ, যে কবিতা পড়লে কবির শ্রেণি-অবস্থান বোঝা যায়। বানিয়ে লেখা কবিতার কোনও অবস্থানই নেই, তো তার শ্রেণি থাকবে কী করে? তুমি যা না, তা সেজো না কবিতায়। তুমি যা, তা-ই তোমার কবিতা। গায়ের জোরে পুঁজির জোরে প্রচারিত হওয়া যায়, কিন্তু প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় না। কারণ কবিকে প্রতিষ্ঠা দেয় কবির মৃত্যু-পরবর্তী সময়। যারা বানিয়ে কবিতা লেখে, তারা কবিতাকে সময়-অতিক্রমকারী ডানা দিতে অক্ষম। ডানাহীন কবিতা পত্রিকা বা বইয়ের পাতায় (বা ফেসবুকে) মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে।
কী নির্মম দৃশ্য!
—বিভাস রায়চৌধুরী
মহম্মদ সামিমের কবিতা
এই লেখা ক্ষমা, এই অক্ষর জোনাকি
শরতের মাঠে পড়ে আছে শস্যের অর্ঘ্য
পুষ্পিত প্রতিমার চোখে গতজন্মের মেঘ
শ্রমের কান্নায় এই জন্ম আশ্চর্য রূপবান
স্নেহের ভাষায় লিখে দাও জলের সংসার
এমন আশ্রয়, অন্তহীন, স্বপ্নের কারুকাজ
কত মায়া ছিল শ্রীদর্শিনী অন্নের বেদনায়?
পৃথিবী জেগে আছে একা, যোগে ও দুর্যোগে…
মন্ত্রের অপার শক্তিতে ভুলে গেছ অপত্যশোক
বুকের ভিতর দ্রোহ, এখনও চলছে বিসর্জন
বন্দরে সান্ধ্য উল্লাস, ভয়হীন কণ্ঠের প্রতিধ্বনি
সময় নিষ্পলক। বিচারক নৈঃশব্দ্যের প্রার্থনায়
নামিয়ে রেখেছি কলম, কী লিখব আত্মপক্ষে
একটি ভোর আজন্ম কেঁদে চলেছে আমার ভিতর…
আলো আমার সমর্পণ, পরিত্রাণ তুমি
তবু অন্ধের কাছে এই ভরা ফাল্গুন বড় মধুময়
নিমগ্ন স্পর্শে বেজে ওঠে নিঃসঙ্গ রোদের একতারা,
শ্রান্ত নদীর অন্তরে ডুবে আছে কালের শাশ্বত ইতিহাস
নীলিমার লাবণ্যে, মুখরিত শব্দের কাছে নতজানু বসি
জেগে থাকি বসন্তবৌরির সবুজ ডানার প্রভায়।
দেখি, জলের নীচে মাছের চোখের ভিতর
অপলক জেগে আছে ঢেউয়ের দুরন্ত বুদ্বুদ
অপার্থিব আলোর নেশায় চিরচঞ্চল তুমি, বৈরাগী
রোহিনী নক্ষত্রের নীচে স্বপ্নবিভোর জোনাকির অবগাহন
গন্ধরাজ ফুলের মতো দুলে ওঠে মন, জীবনের যত অভিমান।
মৃত্তিকাচরিত
যা ছিল, যতটা ছিল, সকল আয়োজন শেষে
চিরতরে ছেড়ে চলে যেতে হবে একদিন
শত কোলাহল, আলোর অহংকার বিলীন হবে একদিন
মিশে যাবে বালি ও মাটির হিমরসে।
তবে কীসের এত উত্তাপ, মগ্ন অবগাহন?
এই সারসত্য সংগ্রহ করে সাঁতার কাটে জীবন
সামান্য শ্বাসের অবলম্বনে পেরিয়ে যেতে চায় সমস্ত গন্তব্য
সঞ্চয়ের ঝুলিতে জমিয়ে রাখে ঝড় ও বজ্র,
ভাবে — পৃথিবী থেকে সমস্ত পথ উপড়ে একদিন
উড়িয়ে দেব আকাশের নীলাভ শূন্যে, জ্বলে উঠবে প্রতিটি শস্যশিকড়
জানি, জলে নেমে গলে যায় দুরন্ত বিদ্যুৎ
নিকষ নিশির অভিমান ধরে রাখে গাঢ় চাঁদ
যতদূর চলে গেলে অদৃশ্য হয় নিঃসঙ্গ অন্তরীপ
ততদূর এই দেহ, সমাহিত, হরিণাভির মতো অনন্ত জেগে থাকে।
মায়ারাগ
বিকেল ফুরিয়ে গেলে কে বেশি নিঃস্ব হয়?
হে নৈঃশব্দ্য, দু’হাত ভরে আলো দাও এই পথে
আমার সমাধিগৃহের মাটি লতাপাতা গুল্মময়
আবরণহীন দেহ, শ্যাওলাঘন, সবুজ ও জলজ
চিরপ্রশান্ত অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছি অন্তহীন…
পশ্চিমাকাশ থেকে নেমে আসে নক্ষত্রের শমী
মগ্নচৈতন্য, মহাশূন্যের অতলে হারিয়ে যায়।
দূরে ভেসে যায় ধূসর চাঁদ, কেঁপে ওঠে বেণুবন
পাড়ে বেঁধে রাখা ছোট্ট ডিঙির উদ্ভাসিত ডানা
শব্দহীন দুলে ওঠে উতলা ঢেউয়ের সমর্পণে।
সব রকম বিচ্ছেদের পর কে বেশি রিক্ত হয়?
অঝোর বৃষ্টি আসবে, ঘন মেঘ শঙ্খ বাজায়
ঝড়ের অসুখে মিশে আছে তোমার মগ্ন ঘ্রাণ
আমাদের মাঝখানে বেজে ওঠে ইমন কল্যাণ।
তপন পাত্রের কবিতা
ঊষার আলো
ধানের চারা মাথায় যে মেয়েটি কাদা ক্ষেতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ও আমাদের লক্ষ্মী।
যে মেয়েটি দিদিমণির ছেলেকে স্কুল নিয়ে যায়, বাড়ি নিয়ে আসে, ও আমাদের সরস্বতী।
অ্যালামিনের ত্যাপড়া বাটি থেকে হাত লুলু লুলু পা সরু পেটমোটা যে ছেলেটি মাড়ভাত খাচ্ছে,
সে আমাদের গণেশ।
ময়ূর নয়, মুরগি পালন করছে যে কিশোর, ও-ই আমাদের কার্তিক।
তুই বলতে পারিস মা, আমাদের এইসব ছেলেমেয়েরা আর কবে তোদের ছেলেমেয়ের মতো হবে?
বড় জানতে ইচ্ছে করে গো। আমিও তো মা,
–মায়ের কোনও জাত নেই।
২
হাতের বল কোথায় উড়ে গেল?
লাঠি পিটে পিটে সেই টায়ারের গাড়ি —
খোকা রে, তোর মুঠোয় অ্যাটম বোম!
ভেবেছিস কি কোথায় দিবি পাড়ি?
৩
মা, তুই কেন পাখি হলি না?
হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছি।
উড়তে দিলি না।
৪
একটা বৃষ্টি চাইছিলাম।
ধানের গোড়ায় জল নেই।
ঝরে পড়ল শিশির।
শিশিরকণা তুলে কুনৌমীর নাকে দিলাম,
মেয়ে আমার নাক বিঁধিয়েছে।
শিশির জলে ধুয়ে
নিমকাঠি পরিয়ে দিলাম —
দু’টি কান ও নাকের ফুটোয় ফুটে উঠল ধানফুল।
৫
ওই তো মেষপালক সিগারেট টানছে,
গরু বাগাল খৈনি ম’লছে।
আমি ভোর-ভোর গরম পোশাক পরে গাভীর মেদুর স্তনে মুখ রাখি, দুগ্ধ পান করি।
আমার হাঁটুতে ক্রুশের চিহ্ন, হাতে আড়বাঁশি।
ভ্যাঁ হোক,
হাম্বাই হোক — সামগান বাজে।
৬
মধু কোথায় থাকে?
একজন বলল –ফ্ল্যাটে, আরেকজন –বোতলে।
খোকা ফুল দেখেনি,
মৌচাকও দেখেনি।
৭
ছোট ছোট যোগ-বিয়োগে বারবার ভুল হয়েছিল।
কাটাকুটি কাগজগুলি মা বিক্রি করেছিল মাধবপুরের কাগজওয়ালাকে।
আজ যখন ঠোঙা হয়ে ঠোঙার ভিতর নুন নিয়ে এল,
আমি বেশ বুঝতে পারছি আমার রোম সমুদ্রে লবণের ঢেউ ওঠে।
শ্যামাপদ মাহাত বাঁশি-র কবিতা
কাঁসাই ও কটলুইয়ের দুঃখের মতো
১
এই গভীর রাতে কেউ কোথাও নেই
টুড়ুহুলু্র কাতর আর্তনাদ কে শুনবে?
পিচাশি শুনেও কিছু করতে পারছে না।
হাহুতাশ হয়ে ডাকছে
মুদালি মুদালি…
কাঁসাইয়ের বালির মতো তারও দুঃখের স্রোত
ছলছল চোখে আঁজলা পেতে বসে আছে
অবনী
আমাদের বন্ধু।
২
উনানে ফুঁ দেয় সন্ধ্যারাণী।
জগন্নাথ বাঁশি ফুঁকে
এই গাঁ থেকে সেই গাঁ
কদমতলা থেকে বটতলায় ভেসে ওঠে ঝুমুরের সুর।
ভাতে ডাল না কুলোলেও রিঝ ছড়ায় ডালেপাতে।
ফুকনলের মতো সংসার
এইপাশ থেকে ওইপাশ ফর্দাফাঁই
৩
ধার উধার করে চালাতেই হবে সারাবছর
লিরনে যেভাবে ডাঁড়ির জলে বেঁচে থাকে জোড় নদী,
সেভাবেই।
জল তো নেই
নদীর পাড়ে জমে আছে বালি
গোটা বছরের বেদনা।
সাইকেলে সাইকেলে বস্তায় বস্তায় বালি
শহরের পথে পথে ঘুরছে
কাঁসাই ও কটলুইয়ের দুঃখের মতো।
৪
হঠাৎ করে যখন আঁধার হয়ে আসে
সমস্ত আকাশ
তখন হিজুলি কাজুলি আমলাতোড়ায় কোনও তফাত নেই
একবার শূন্য মনে হলে
কোনও বাঁধনই বাঁধতে পারে না আর
ষাঁড় এসে যেভাবে ছত্রভঙ্গ করে দেয় গাইগোরুর গোঠ
ঠিক সেভাবেই
খুরের ধুলোয় উড়ে যায় সমস্ত ভালবাসা।
৫
করণডি থেকে কাজুলি
এক গাঁ থেকে আরেক গাঁ
ভাজাভিজা বিকতে আসে গঙ্গারাম।
ভেজা মটরে সেদ্ধ ছোলার মতো
মা ছা’য়ের সঙ্গে মিশে যায় যথা-তথা।
পথে ঘণ্টি বাজলে
ঘর-ভিতরে টিকু টানে মায়ের আঁচল।
ছানার মায়ের খুঁটে দু’-পাঁচ টাকা
ইধার উধার করে রাখতেই হয়।
না থাকলে কাঁদে ছানার মন
ছানার মন ভোলাতে বোঁটার দুধ
গঙ্গারামের মন কাঁদলে
রাঁধনাশালে লঙ্কা বাঁটে টিকুর মা।
প্রকাশিত