You are currently viewing সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম ১৪৮ সংখ্যা

সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম ১৪৮ সংখ্যা

শুভংকর পাত্র

চলতি সময় থেকে অনতি-অতীত ইতিহাসের সময়, সেখান থেকে যুগ পেরিয়ে মহাসময়ের দিকে ছুটে চলে গল্পের ছলে বলা শুভংকর পাত্রের কবিতা। উঠে আসে অমোঘ বিশ্বাস— “সত্যির মৃত্যু নেই…”

শুভংকর পাত্র

সত্যি

      লোকজন ভাবনা চিন্তার ভুলে হতাশ হয়ে

নানান কথা বলে, বলে, “এটা কলিকাল রে ভাই,

এখন আর সত্যি বলে কিছু নেই !              

দুনিয়াটা একেবারে মিথ্যেতে ভরে গেছে!”

           সত্যি বিষয়ে আমার এরকম কোনো হতাশা নেই।     সব জায়গাতেই তো সত্যি আছে,

                                  জলজ্যান্ত সত্যি আছে।

আমরা সবাই দেখি,

                        ভোর হলে পাখিরা ডাকাডাকি করে,   সন্ধ্যে থেকে কিছুই খায় নি,

                                এখানে ওখানে খাবার খুঁজতে যায়।  এসবই তো সত্যি।

                                 আরও একটা ঘটনার কথা বলি। সবাই জানে, মৌমাছিরা ফুলে ফুলে ঘোরে,

          মধু এনে মৌচাকে রেখে আবার মধু আনতে যায়।    এটাও একটা সত্যি, এর মধ্যে কোনো মিথ্যে নেই।

          সময় হলে খাটিয়ে চাষী জমিতে বীজ বুনতে যায়, সময় হলে চাষীর খাটিয়ে বৌ গরুর দুধ দোয়,

                                ছাগলের দুধ দোয়, উঠোন নিকোয়, রান্নাবান্না করে, ছেলেমেয়েদের খেতে দেয়,

      চাষী ঘরে ফিরলে গুড়মুড়িজল দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আজ কোন মাঠে গিসলে গো ?”

                                         চাষী বলে, “ঝুমঝুমির মাঠে।”

        এর মধ্যে আমি কোনো মিথ্যে খুঁজে পাই না।

                                    মেয়েটা মারা যাবার পর আমাদের চৈতলপাড়ার আরতির আস্তে আস্তে

মাথা খারাপ হয়ে গেল,

                 আরতিকে কালোর ওপর খুব ভালো দেখতে,

             বালি বাজারের সামনে বসে ভিক্ষে করে,   কোনো ঝামেলা করে না, সবাই ওকে ভালোবাসে,       

ভিক্ষে দেয়, এটা ওটা দেয়,

                                        বাড়ি থেকে খাবার এনে দেয়, চায়ের দোকানের শ্যামল রোজ ওকে

                                         দু’বেলা চা বিস্কুট দেয়। এর চে বড়ো সত্যি আর কী হতে পারে !

               এই যে সুব্রতর সঙ্গে জয়া আজ পালিয়ে গেল,  রেজিস্ট্রি বিয়ে সেরে মন্দিরে গেল,

         শাঁখা সিঁদুর নোয়া পলা পরে সুব্রতদের বাড়ি গেল, শ্বশুর শাশুড়িকে প্রণাম করে

                                     মাকে ফোনে সব কথা জানালো।  মা ভীষণ রেগে গিয়ে বললো,

                           “আমি আর তোর মুখ দেখতে চাই না।”    এও তো সত্যি, অতি সত্যি !

তবে তুমি যদি সত্যিকে খামোখা জটিল করে

                                  জানতে চাও, ভাগ্য আছে কিনা, ভগবান আছে কিনা, ভূত আছে কিনা,

                               সাম্যবাদ বলে কিছু হয় কিনা, আটচল্লিশের বইটা ঠিক ছিলো কিনা,

                     সতেরোয় বিপ্লব হয়েছিলো কিনা,   একানব্বুইয়ে সাম্য তুলে দেওয়াটা ঠিক হয়েছে কিনা,

 জাপানে ওরকম দুটো বোমা ফেলা ঠিক হয়েছে কিনা…  তাহলে আমি বলবো,

               এসবের মধ্যেও সত্যি আছে, মহা সত্যি আছে, বড়ো করুণ সত্যি আছে।

          এইসব ঘটনাবলি থেকে, এইসব কথাবার্তা থেকে যে কথাটা জলের মতো বেরিয়ে এলো,

                                                 সেটা সংক্ষেপে এরকম : সত্যযুগে সত্যি ছিলো,

    ত্রেতাতে, দ্বাপরে ছিলো, এই কলিযুগেও সত্যি আছে,  

এর পরেও সত্যি থাকবে,

                                       তোমরা মানবে কিনা জানি না, আমি সাষ্টাঙ্গে খুব মানি,

                কোনো কালেই সত্যির মৃত্যু নেই।


পারমিতা ভট্টাচার্য

মন একটাই। তবু সময়ের সঙ্গে, বয়সের সঙ্গে কত না পরিবর্তন আসে! যে ঘটনার অভিঘাত অসহ মনে হয় একসময়, যুগের ব্যবধানে তা হয় অভিজ্ঞতা মাত্র! ক্রমশ প্রতিভাত হয় সমস্ত অভিজ্ঞতাই বস্তুত নৈব্যক্তিক!

পারমিতা ভট্টাচার্য

পৃথিবী এমন জাদু

বলো তীব্র জলকষ্ট এ নাম শোনায় ,
অগত্যা স্বীকার করো, প্রণয়াভিমান
যতদিনে বুঝেছিলে, তার আগেই প্রায়
পণ্ডিতমন্য সেজে হেরে গেছ দান
সহজ মাটির কন্যা গাঢ় হয়ে গেলে
চিনেছে চাতক চোখ, এইবারে, ফলে
বালি বালি সব স্থানে ঢেকেছিল হায়
অধীত কুমারী বিদ্যা। অহং-এর তেজও
মুছেছিল স্লেট … তবু অহরহ আজ‌ও
নাম শুনে খাঁখাঁ রোদ, স্থির থাকা দায়!

কে শোনে বিষাদকাব্য, বিকেলের মেয়ে?
সকালে প্রত্যয় ছিল, ছিল নির্বাচন
আঙুলে তুলেছ ত্রুটি খুঁটিনাটি গায়ে
এত কি সহজলভ্য সুললিত মন!
আকাশে উড়েছ, পাখি যেমন খেলায়
ডানার বিন্যাস আর চোখ থাকে ভুঁয়ে
“কী জানি জন্মিতে পারে মম সমতুল
অসীম সময় আছে বসুধা বিপুল “—
এই ভেবে জ্যোৎস্নাকে গিয়েছিলে ছুঁয়ে
নীরবে অপেক্ষা তার ছিল কিছুক্ষণ!

এ ব্যক্তিচারণ শুধু অহেতুক জেনে
নিভিয়ে নিয়েছি, তবু পড়ে যায় মনে
সারল্য দুর্লভ, তাই মৃত্তিকা মেয়ে
সহজে নিকটে এলে, তাকাল সে চেয়ে!
নিষ্ঠুরতা ফেরানোর নিবিড় ইচ্ছায়
সমূহ আবেগ বুঝি তুচ্ছ হয়ে যায়!
প্রথমে কৌতুক ছিল তোমারও, ক্রমে
কোথাও বিষাদ ছায়া অচিরে ঘনায়…
মনকে বাজিয়ে দেখে এতদিন পরে
অমেয় শূন্যতা চারিদিক ঘিরে ধরে!

পৃথিবী এমন জাদু, কখন কোথায়
সোনাবালি ধুলো করে এক লহমায়!
হঠাৎ বিপন্ন হয়ে চারপাশে খুঁজি
যাকে, সে ততক্ষণে ভুলে গেছে বুঝি
অতীতে ফেরার পথ। অ্যালবামে দেখি
এত মুহূর্ত মুগ্ধ … সব কিছু মেকি?
ভাবতে ভাবতে আর দিন যেতে যেতে
সুনামির মতো স্মৃতি, গেল ভেসে স্রোতে
শুনেছি সে দূরদেশি— সাগর পেরিয়ে,
নামের উল্লেখমাত্র গিয়েছি এড়িয়ে

নটেগাছ মুড়িয়েছে, বোঝবার পর
বহুকাল গত, দিন নিজের নিয়মে
হাঁটে, চলে বিকেলের প্রান্ত বরাবর
গোধূলির ক্ষণে বার্তা ই-মেলের খামে
“জীবন সুন্দর, আর বড় বেশি দামি
এতদিন ধরে সার বুঝেছি তা আমি,
তুমিও ভাল তো? দিয়ো উত্তর প্লিজ…”
ছবি আছে গাড়ি, বাড়ি, সকন্যা সস্ত্রীক!
যেন আনন্দের হাট, মহা বিজ্ঞাপনও
নাকি এ শ্লেষ? লক্ষ্য পুরাতনী কোনও…

তুমি দেবে, কী জবাব দেবে এ ডাকের ?
পাল্টা হাওয়ায় খেলবে সুখ সুখ গেম ?
কখনও না ; শুধু ওই নাম আসে ফের,
আর ভাবো কতকাল ভুলে থাকা প্রেম
আর তীব্র জলকষ্ট, ও-নাম শোনায়…
তবু ভাল লাগে খুব, কে জানে তা কেন!
সব কিছু একসাথে পেয়ে গেছ যেন!
এ ছোট গ্রহের মাঝে কিছু কি হারায়?
প্রকৃতি মিলন লেখে কালের খাতায়!
জীবনে প্রতিটি পল তারই অপেক্ষায়…

বর্ষার ছেঁড়া মেঘে ভাঙা চাঁদ হাসে,
নিশ্চুপ রাতের ছবি গ্রহের এপাশে!
আকাশে যমজ তারা, মুখোমুখি ঠিক
অত দূর তবু তারা কত আন্তরিক,
যোজন আলোকবর্ষ পেরিয়ে সে আলো
তোমাকে হৃদয়ভাষা পড়তে শেখাল।
কোথা থেকে ভেসে এল অমলিন ডাক
জীবন অনন্ত, তার কোনওখানে ফাঁক
নেই। আছে শুধু ওই মেঘেদের মতো
কিছু ধূলি , কিছু জল আর কিছু ক্ষত…