You are currently viewing সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম ১৬৮ সংখ্যা
By Haku Shah

সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম ১৬৮ সংখ্যা



বাংলা কবিতার ভুবন বিস্তৃত––এই সত্য উপলব্ধি করলে পাঠককে সন্ধানী হতে হবে। কবিতার ভুবন একক সংগীত নয়।পরিব্রাজকের মতো সন্ধান করতে হবে, তা না হলে কত কত বিচিত্র ঝরনা অনাবিষ্কৃত রয়ে যাবে, অপার সৌন্দর্য নিয়ে হারিয়ে যাবে।

––কবিতা আশ্রম

অশোক দেব

আমাকে রেখেই তুমি গরম করেছ জল,
একটা সিগারেট খেয়েছ কাশতে কাশতে,
রঙের প্যালেট থেকে রং নিয়ে মেখে নিয়েছ জিভে–
দেখতে পাচ্ছি সব।

দেখতে পাচ্ছি, ঘোড়ার নাল নামিয়ে আনলে,
সোনা-রুপা নামালে, পুরনো মদের বোতলে যা একটু ছিল
পান করলে, নিজেকে মাতাল ভেবে নাচলে একটু
কাকে যেন পাঠালে রিপুও––

সকাল এল,
অনেক দেরি করল আজ।

যারা কাঁদছে তারা কবেই ভুলেছে অশ্রুবিদ্যা!
কে যেন তুলসীর গাছ তুলে আনল
শেকড়ের বেদনা সহ। ধূপ দেবে বলে কে যেন
জ্বালাল নিভন্ত অঙ্গার। দেখছি সব

দেখি না তোমাকে আর,

ওরা নিয়ে এল এখানে, নদীপাড়ে।
হাঁ করে আছি––
ছেলেটা আমাদের, জীবনে প্রথম
আগুন জ্বালাল

প্রথমে বাছাই করো সঠিক জোছনা,
ঘোড়াশাল থেকে আনো ঘোরতর অশ্ব।
নিদ্রিত নারীর বুকে জোনাকি গেঁথেছ?

এবার নিজের ছায়া মুছে ফেলে এসো

বৃক্ষতলে আমি আছি তোমার ছায়াটি,
দেহের বদলে আজ নির্বাণ কিনবে?

মেঘবর্ণ পেশীর আন্দোলনের সঙ্গে নয়। বাবরি চুলে লুকানো মোহর কিংবা জাদুপুষ্করিণীর নথ পরা মাছের জন্য নয়। শ্রাবণভরা নদীতে সটান দাঁড় টানতে পারে বলেও নয়। হাসির সঙ্গে নয় তার, মূলত তার বাঁশির সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল। মায়া দিয়ে লেপা উঠোনে আলতা-আলতা সে বিবাহ কার মনে নেই!

         মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে মেয়েটি। ভাল করে দেখলে বোঝা যায়, সে মেয়ে মেয়ে নেই আর। দেহভরা ছিদ্র।  দূরে গিয়ে শ্বাস  নেয়, শ্বাস ফেলে।  শ্বাস নিতে গেলে বেজে ওঠে  তার হংসধ্বনি, বিলাবল। কেউ কেউ শুনে ফেলে…

প্রকৃত বিবাহ কি এমনই,

নারীকে একদিন বাঁশরী বানিয়ে দেয়

স্পর্শে মানা, তাই আর হাত ধরি না তোমার।
নিজের হাতকেই তোমার বলে চালাই—
ধোঁকায় রাখি নিজেকে। এ-হাতকে বলি
ও-হাতটি উহার। ধরে বসে থাকি, যেন এ
দেহেই আছে অর্ধেক গোধূলি,
আর অর্ধেক চলে যায় ডমরু বাজাতে––

ছাই ছানতে গিয়ে সেদিন খসে পড়ল হাত।
রক্ত নেই, বেদনা নেই; কেবল কাঁপন ছিল
আকাশে আকাশে। হস্তহীন, জানতে পেরেছি,
নিজেকে ঠকালে শেষে ডমরুবাদ্য খুনি হয়ে যায়।
এখন হাত নিয়েছে, ধীরে ধীরে নিয়ে যাবে

সম্পূর্ণ গোধূলি


অচিন্ত্য মাজী

মসিনার এই পথ দিয়েই তুলিনের মেয়ে পুরুষেরা
পদ্মপুকুরের মুলন কাড়তে আসে
এখন ভরা গ্রীষ্ম, পদ্মদিঘিতে জল অনেক কম
তেঁতুলগাছের পাতায় পাতায় রোদের ঝিলমিল
প্রখর রোদের তাত ফেনা হয়ে জ্বলে

সপাং করে হাত ঢুকে যাচ্ছে পাঁকাল মাটিতে
জলের অনেক নীচে কোথায় পদ্মমূল?
দৃষ্টি নেই শুধু স্পর্শ, চোখ বন্ধ করে শুধু সন্ধান
আঙুলে আঙুল, হাতড়ে চলে শিকড়ের গাঁট

এই তো আশ্রয় এই তো দিনলিপি
বিনি মাঝি আর তার বউ নরম পাঁকের তলে সাজায় সংসার
ওইখানে বেজে ওঠে শ্রম ও সমর্পণ

রোদের ঝাপট খেয়ে বিনি মাঝির বউ হয়ে ওঠে পদ্মমুখী দেবী

কে এল এই অবেলায়?
দরজা খুলে দিতেই দেখি কেন্দুয়াডিহির সেই লোকটি
মাঝে মাঝেই তাকে দেখা যায় রথতলার হাটে
বাঁশের ঝুড়িতে রাখা তিলফুল, ভেষজ গাছের ছাল ও শিরা
বৃষ্টির ফোঁটার মতো মাটির টাঠির ভেতর গুঁদলুর বীজ
হলুদ টুপায় রাখা কচি বাঁশের ফোঁড়গুলি
তার চোখের মতোই জ্বলজ্বল করে উঠত বিপুল ভিড়ের মাঝে

আজ তার হাতে কিছু নেই গলায় ভক্তার মালা
কাঁধে প্রদীপের শিখার মতো ভক্তা ফুলের থোক
ছেঁড়া জামার ভেতর দানাদার ফুলের পাপড়ি
সে আমার পাশ দিয়ে হেলতে দুলতে চলে গেল ধুপড়ির শালবনে

আমার ঘরের ভেতরে বাইরে এখন ফুলের গন্ধ, ফুলের আলো

আকন গাছের গাঢ় ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিল সাপটি
বেগুনি ফুলগুলির নিবিড় আঠা হয়তো শুষছিল
কিংবা আত্মমগ্ন আর সুষুপ্ত, ভয়াল আর রূপময়
বিষ আর বীর্যের বন্ধনে ক্রমে ক্রমে হচ্ছিল সুন্দর

পেলু হাঁড়ি অতশত বোঝেনি
আকন ফুল পাড়তে এসে খেল ছোবল
দিগন্তে তখন ঈষৎ অবনত অন্ধকার
পেলু হাঁড়ির রক্তে বিষরস, মৃত্যুর বীজ
কালো শরীর একটু একটু করে কেমন নীল মায়াময়

তারপর থেকে সাপটিকে পাওয়া গেল আদুড় বেদের ঝাঁপিতে
কালো চিকন শরীরে মায়াবী রূপ নেই
গভীর ফোঁস কেমন করে দগ্ধ হয়েছে জানে শুধু বেদে
শালপাতার চুটিতে সুখটান দেয় আদুড়
তার হাতে ধরা জন্মমৃত্যুর বাইরে অপরিসীম রূপের মরীচিকা

স্টেশন থেকে বেরোলেই কাঁচা সড়ক ধরে সোজা রুপাই ডুংরি।
সওয়ারের অপেক্ষায় ভরু বাউরি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে।
তুলিনের সর্বত্র টোটো, শুধু ভরু বাউরি কিনতে পারেনি।
প্রপিতামহের রিকশাটিকে আগলে রেখেছে যত্নে।

সেদিন ঝিরঝিরে বৃষ্টি, স্টেশনের কৃষ্ণচুড়া গাছে পাখিরা ভিজছে।
ভরু বাউরি কাঁচা রাস্তায় দাঁড়িয়ে
হুসহাস পাশ দিয়ে পেরিয়ে যায় টেম্পো আর টোটো।
গায়ে তার জ্বর, আধ-খাওয়া বিড়িটি পুড়তে পুড়তে ডগা অব্দি পৌঁচেছে।

সেই মেঘান্ধকারে ভরুর চোখ সহসা রুপাই ডুংরির বালির মতো চিকচিক করে ওঠে
চোয়ালের হাড় খাড়া, পেশি ফুলতে থাকে
সওয়ারহীন রিকশা নিয়ে একাই চলে ডুংরি ব্রিজে।

সওয়ারহীন ভরুর স্বপ্নে তখন গন্তব্যের নেশা।
তার চুলে বিলি কাটে পরাজাগতিক হাওয়া।
তামাটে চামড়ার মধ্যে ডুংরির পলির আঠা
রিকশার ভেতর মিশে যেতে যেতে সে একসময় রিকশা হয়ে ওঠে।


Leave a Reply