নির্মল হালদারের সাম্প্রতিক কবিতা
কবিতাই তাঁর জীবন। আলাদা করে ইস্যু ভিত্তিক কিছু লিখতে হয় না তাঁকে। তিনি ধারণ করেন পুরুলিয়ার প্রকৃতি। তিনি ধারণ করেন লড়াকু মানুষের ভালবাসা, বিষণ্ণতা, ঘুরে দাঁড়ানো। উত্তাল সময় উঠে এসেছে নির্মল হালদারের নতুন কবিতায়। যেন একটা পাগলা হাওয়া গাছের কানে কানে কিছু বলে যায়। কবি এই পর্যায়ে অনেক কবিতা লিখেছেন। আমরা দশটি কবিতা প্রকাশ করলাম।
…কবিতা আশ্রম
মহাভারত এক গ্রাম
১
তোর মহাভারতে হয় জন্ম, না কি ভারতে?
তোর জন্ম কি শস্য-শ্যামল বাংলায়?
তুই কি ধনুকে জুড়বি তির?
পাখি দেখতে দেখতে আকাশ দেখবি তো?
আকাশ দেখতে দেখতে মাটি দেখবি তো?
মানুষ দেখবি তো?
মানুষ দেখতে দেখতে হাহাকার শুনবি তো?
এ কথা বলতেই পারে না কুন্তি
আদরের অভি দাঁড়িয়ে থাকে একা।
২
আজকাল ভয় করে সব সময়
কে কখন হয়ে উঠবে দুর্যোধন
কে কখন হয়ে উঠবে দুঃশাসনের হাত!
গাছের ডাল মাথা ছুঁয়ে গেলে দ্রৌপদী আঁতকে ওঠে
হাওয়াকে সন্দেহ করে যদি আঁচল ওড়ায়?
যে হাত অভয়ের সেই হাত যদি শাড়ি টানে?
হাতকেও সন্দেহ করে
যে-কোনও হাত হয়ে উঠতে পারে
ভয়ংকর থাবা।
৩
মা ছাড়াই একজন হয়েছে বড়
স্তন্যপান না করেই হয়েছে মানুষ
পাঁচ সন্তানের জননী হয়েও সে কি জননী?
কুন্তির মাথায় ঘূর্ণি হাওয়া।
৪
কার পাশে যে মানায়?
ভীম না অর্জুন?
যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে মানাবে?
নকুল সহদেব তো সন্তানের মতো
দুধ-মুড়ি দিলেই খুশি-খুশি মুখ।
খুশি-খুশি মুখের আলো ছুঁয়ে
দুঃখের কাছে দাঁড়ানো
সারাদিন পাঁচটা মুখ
কেউ চাইছে সজনে শাক সেদ্ধ
কেউ চাইছে, কাছে এসো…
আর দ্রৌপদী?
একলা মাঠে আমড়ুর লাল রং
আদর করল না কেউ।
৫
যেখানে যা ছিল সবই আছে
উঠোনে পড়ে ছিল একটা পেতলের কলসি
ঘরের চালায় বেড়ে উঠছে দুটো লাউ
চুরি যায়নি।
পায়ের ছাপও নেই
তবে কে এসেছিল, কে সিঁদ কেটে গেছে?
ধর্মরাজ কি এসেছিল পাপপুণ্য দেখতে?
ঘুম থেকে উঠেই আলুথালু কুন্তি
চারদিক হাতড়ায়।
৬
ছুঁচের ডগায় যেটুকু মাটি ধরে
দুর্যোধন দেবে না
দুঃশাসন চোখ রাঙায়
যুধিষ্ঠির জানে, তাদেরও ভাগ আছে।
পৈতৃক ভিটে।
লাঠালাঠিও করতে ইচ্ছে করে না
ভীম চেঁচায়—সব ভেঙে দেব সব
গাড়োয়ানটা বলে, ভয় করবে কেন?
আমি এক গাড়ি বাঁশ এনে দেব
যেমন ইচ্ছে লাঠি খেলবে তোমরা।
৭
মেঘে মেঘে কালো
রাস্তাতেও কালো কালো কাদা
রাস্তায় পা ফেলতে ইচ্ছে করে না
কার কাঁধে উঠবে দ্রৌপদী?
অর্জুনকে বললে বলবে,
শখ তো তোমার মন্দ না, আমার কাঁধেই চলো
কিংবা আমার কোলে
তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে
তোমার পায়ের দিকে তাকিয়ে
তোমাকে নিয়ে যাব তেপান্তরের মাঠ।
৮
পাশাপাশি দু’টি গাছ
কলাগাছের ফুল এলেও মালা গাঁথা যাবে না
পেয়ারাগাছে ফুল এলেই মালা গাঁথবে দ্রৌপদী
কার গলায় পরাবে মালা?
৯
লেবুগাছ থেকে গন্ধ আসে
মন কেমন করা গন্ধ মনকে উতলা করে
মন যে কোথায় আছড়ে পড়বে দ্রৌপদী জানে না
দ্রৌপদী জানে, পাঁচটা পুরুষ পাশাপাশি থাকলেও শরীরকে কল্লোলিত করে না।
১০
বাঁশও বংশ বিস্তার করে
আপনমনে থাকে হাওয়া দোলায়
বাদ বিবাদ নেই
আর পাঞ্চালীর শ্বশুরঘরে?
হানাহানি খুনোখুনি দিনরাত্রি ভয় ভয়
আতঙ্কে শুকিয়ে ওঠে কলসির জল
দূরে দাঁড়িয়ে থাকে তৃষ্ণা।