বন্যা আনকোরা এবং আশ্চর্য কবি। ইতিমধ্যেই প্রতিশ্রুতির লক্ষণ সুস্পষ্ট। ওর সংযমী এবং গভীর ইশারা নাড়া দেয়, বিচলিত করে। সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত অগ্রজ দেবাশিস চন্দের প্রজ্ঞাময় কবিতা সস্নেহে আঙুল ধরে পাশাপাশি হাঁটে কাব্যের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে । প্রবীণ এবং নবীনের এই সম্মিলিত যাত্রা স্মরণীয় হোক আবহমান বাংলা কবিতায়।
…কবিতা আশ্রম
দেবাশিস চন্দ
শোকের ভেজা তুলো
কচুপাতায় জলের মতো পিছলে যাওয়া অকিঞ্চিৎকর জীবন,
সংগ্রহে দেখানোর মতো কিছু নেই, নেই শীতল পাটির হাসি,
নেই কোনও মহার্ঘ্য সিন্দুক, নেই সবুজ পাতায় লিখে রাখা
চৌকাঠ, জীবনের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার রত্নশোভিত গল্প–কাহিনি,
জীবনই যার নেই তার যাপনের আবার কী গল্প, কী কাহিনি!
নেই সুখস্মৃতির মখমলবালিশ, নেই আনন্দলিপি,
সঞ্চয়ের কোঠায় শুধু এক বিষণ্ণ আকাশ, দুঃখী নদী,
রোয়াঁ ওঠা অসুখী দাম্পত্যের শ্বাসরোধকারী ধোঁয়ায়
জল থেকে তুলে আনা মাছের মতো খাবি খাওয়া।
আলোহীন আশ্রয়হীন পালহীন নৌকোতে এগিয়ে
আসেনি সহানুভূতির কোনও ছাতা, ভরসাবৃক্ষছায়া,
যতিচিহ্ণহীন ভেসে যাওয়া, একাকীত্বের অসহায়
কান্নায় জীবনের রং চটে গেছে, কাটাকুটি খেলার
হৃদয়আগুন নেভে না, নেভানোর মতো দেখায়।
অথচ একদা মরুভূমিজীবনে নেমেছিল জলপ্রপাত,
নৃত্যছন্দে সে দেখেছিল স্বপ্নউড়ান, সূর্যউজ্জ্বল চলা,
সেই স্বপ্ন রয়ে গেল অধরা, একতরফা ভালবাসার
আগুনে পুড়ে ছাই সে জানে না নিষ্ক্রমণের পথ।
পিছন ফিরে তাকালে এখন শূন্যতার চিতাকাঠ,
শোকের কার্পেটে মোড়া, কাঁটায় কাঁটায় কণ্টকিত
আত্মজনের ছোবলে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া,
ক্রমশ পিছিয়ে পড়া— এক পা এগিয়ে আট পা,
হারানো পথ ফিরে আসে না, জীবন তো একটাই।
শুকিয়ে গেল নদী, সবুজ শস্যক্ষেত্র পোড়া মাঠ,
সে তো কারও ক্ষতি করেনি কোনওদিন,
সবার ভাল চেয়েছে, ভাল করেছে, তাহলে
তার জীবন কেন ছেঁড়া কাঁথার বিষাদবুনন!
শোকের ভেজা তুলো, বিষাদের আলকাতরা,
নষ্টকষ্টজীবনের আবর্জনা পুড়িয়ে চলে যাওয়ার
সময় কোনও বিলাপ নয়, কাউকে দোষারোপ নয়,
সাঁতার কাটতে না জানলে তো ভেসে যেতেই হবে,
সে শুধু বলছে— ভাল থেকো, সবাই ভাল থেকো।
বন্যা লোহার
ইশারা
প্রভূত সংকেত আসে
দৃশ্যে শব্দে অথবা স্পর্শে
সকলই কি বুঝি?
ভেবেছি মহাবিশ্বের পথ ধরে
আসা কার ডাক
চিৎকার ক’রে
অথবা নিচুস্বর
অথবা ঘুমের ভেতর সন্তর্পণে
অনুজ্জ্বল নক্ষত্র বা
বিষণ্ণ কুসুম ঝরে পড়ার মতো
এসব কথা সকলকে বলার নয়
সকলে বোঝে না
কেমন বিপর্যয় পেরিয়ে
তবে পেয়েছি
এ নৈঃশব্দ অবলীলা
অন্তর্লীন সন্তরণ
সতত তরঙ্গময় কুহকে
সহাবস্থান
পাঁজর জড়িয়ে নামে
অসংখ্য লতাপাতা
প্রাচীন শিকড়
এবং অমানিশা অনন্ত
এমন মাটিতে কি জন্মায় অরণ্য
তাবৎ সম্ভাবনা কল্পনা করি
কল্পনা করি অসম্ভব
যা কিছু হয় না
বৈদূর্য মায়া
অদ্বিতীয় জ্বলে
উপেক্ষার সমীপে
তার উত্তরাধিকার
আর কে-বা নিতে পারে
আমি ব্যতিরেক
প্রেমিক অথবা লুসিফার
আমি কি দেখিনি তার হাত
দু’খানি কালো পালকের ডানা
আমাকে টেনে এনেছে
বিস্তীর্ণ তমসায়
এহেন প্রহেলিকা লিখেছে
যেন-বা মৃত্যু
যেন পান্নাসবুজ ঘুম
উঠে এল আমারই চোখের দৃষ্টি হতে
ক্ষীণতনু চাঁদের কৌটায়
বেঁচে ওঠে গতায়ু জীবনের ভ্রমর
প্রস্থানরত পায়ের শব্দ
এবং গোপনে বলার মত
যা কিছু কথা
মায়াপৃথিবীর বালুচরে
এই তো আমার মুক্তিজোছনা
অন্তর্ঘাত
বিশ্লেষণ করি
আমার অন্তরস্থ তিমির
এবং তিমিরাতিত দৃশ্যবিন্যাস
জনশূন্য চরাচরে অগণিত নরখর্পর
ঢেকে আছে মাটি
তরুশাখাসমূহ নিষ্পত্র
চমকপ্রদ বিষাদ ঘনীভূত হয়
যেন মরীচিকা
খুঁজি কেউ ছিল নাকি
ইহজন্মে আত্মীয় আমার
অথবা জন্মান্তরে
পথে পথে ঘুরি
নিরুদ্দিষ্ট
আঁধার অথবা
আধার মুক্তিস্বরূপেণ
গন্তব্যে পৌঁছতে নিরন্তর বিলম্ব হয়
প্রকাশের পথে