You are currently viewing সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম ১৪৩ সংখ্যা

সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম ১৪৩ সংখ্যা

By Jamini Roy

রুমা তপাদার

দিবাস্বপ্ন ব’লে অনুরাগ থেকে চোখ সরে না আজকাল।
পুরুষ চেহারা হলে তোমাকে বসিয়ে ভাবি,
ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে যায়।
ঘুমের ভেতরে ঢুকে দেখি
তুমি স্নেহ দিচ্ছ আমাকে
ঘোর থাক ঘোর থাক মনে মনে ডাকি ‘আয় ঘুম’
ঘুম আসে না তখন, চোখ থেকে আগুনের কণা পড়ে টুপ টুপ করে সম্মুখে
ঘোর ভাঙে।
ভাঙার সে-শব্দে মনে মনে বলি এরপরে যদি কেউ কবিতা লেখেন বিরহের…
পাতার উপরে যেন লেখা থাকে ‘প্রেম’।
পাতার উপরে লেখা যেন থাকে ‘পূজা’।
আমি তাঁর হাতে দেব আমার বিরহ।

By Chitranibha Chowdhury

অমিত সাহা

“দুঃখ যেন করিতে পারি জয়”

দুঃখ শব্দের ভেতর 
         শুধু দেখেছি তোমাকে…
আনন্দ ধারার স্রোতে 
          আশ্রমমাঠের চাঁদ 
          উড়ে গেছে কোপাইয়ের বাঁকে…


কখনও বুঝিনি আগে 
          দুঃখ শব্দটির এত আলো! 
একখানা গীতবিতান 
আত্মাকে চেনালো…

“নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়”

অন্য বিশ্বাসের আগে 
মনকে বিশ্বাস করা জরুরি…


কোন জায়গায় নিজেকে গুরুত্ব দেব ?
কেনই বা দেব ? 
                 তুমি তো জহুরি! 


শরীরের ক্ষয় হয় হোক…  
                 কর্ম দেহের সাধনা!
সকল শোক ইতিবাচক
সংকল্প জীবন লিখে যায়…
মনের সঙ্গে আত্মার যোগে—
বিশ্বাসে ফিরুক সৎ সম্ভাবনা!

“তোমারে যেন না করি সংশয়”

সম্পর্ক বিশ্বাস চায় 
          এবিষয়ে পৃথিবী সজাগ, 
বিশ্বাসে সন্দেহ দরকার ? 
কথা বলো… কথা বলো…
          একার সঙ্গে একার। 

তুমি যে তুমিই—মহাবিশ্বময় 
সন্দেহ আর সংশয়
         এক নয়… এক নয়… 


এই বিশ্বাসে জীবন অপেক্ষমান
ভালবাসা পূজা হলে 
               তুমিই আবহমান…

               

By Xu Beihong

তৈমুর খান

এই ঝড়ঝঞ্জাময় সভ্যতার সংকট আঁধার পথে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতে চাই। এই স্মরণ উচ্ছ্বাসের নয়, কোলাহলের নয় ,নিতান্ত আত্মানুভূতির ব্যক্তিগত প্রশ্রয় মাত্র। বস্তুপৃথিবীর বস্তুরূপ ছাড়িয়ে ভাবরূপের ভাবকল্পে সর্বদা এক আত্মসন্ধানের ভেতর ডুবে যাই। এই ডুবে যাওয়া যে আত্মনির্মিতিও তা একান্ত ধ্যানতন্ময়তায় কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন। নীরবতার মাঝেই তো আত্মার স্ফুলিঙ্গ মহাত্মার পথে ধাবিত হয়। তাই পার্থিব ক্রিয়াকর্ম অসন্তোষ অপূর্ণতার ঊর্ধ্বে শাশ্বত মহাজীবনেই আমরা পর্যবসিত হতে চাই। শান্তির এই পথে যাত্রা করতে হলে সতর্কও থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’র প্রথম গানেই তা বলেছেন : “আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে ; তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবন-মাঝে।” আমার কাজ তখন আর আমার কাজ থাকে না; সেই পরম পুরুষের কাজ হয়ে যায়; চিরমানবের কাজ হয়ে যায়। স্বার্থ-সংকীর্ণতায় আবদ্ধ ক্ষুদ্র দুর্গন্ধ জীবনকে মুক্ত করার বাঞ্ছা তো রবীন্দ্রনাথই আমাকে এনে দেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে যে ঈশ্বরকে আমি পাই তা যেমন কোনো ধর্মীয় বিলাসিতার নিয়মানুগ ঈশ্বর নন, তেমনি কোনো ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পুরুষও নন। এক উপলব্ধির ঈশ্বর, যে আমার মর্মের ব্যাকুলতার শান্তশ্রী দিশারি মাত্র। যে জটিলতায় সমাচ্ছন্ন জীবন, আদিমতার গন্ধবাহী প্রলোভনে নিয়ত কদর্য ও হননপ্রিয় ,তাকে একমুঠো নিরিবিলি বাতাস দিতে পারি ‘গীতাঞ্জলি’র অন্তঃগূঢ় বাতায়নে। আত্মাকে বলতে পারি এখনও : “অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে। নির্মল করো উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে।” বিকশিত নির্মল উজ্জ্বল সুন্দর করার সাধনা কে দেবে? নিজেকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারলে তো পৃথিবীও সুন্দর হয়ে উঠবে। সকল হৃদয়-দুয়ারও খুলে যাবে। ‘বিকশিত’ শব্দটিই মানববন্ধনের ইঙ্গিত দেয় , আত্মার আত্মীয় করে তোলে প্রত্যেককে। মানবপ্রাণ যখন জেগে ওঠে, সত্যিকারের আদিমতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তখনই তার পূর্ণতার সন্ধান আসে। আনন্দের বিরাট বিস্ময়ের দরজা তার সামনে খুলে যায়। সংশয় তো এক একটি মায়ারই টান মাত্র। জীবন সাধনায় অগ্রসরের পথে এই সংশয় উঁকি দিতে পারে। কিন্তু ভয় কী ! অগ্রসর হতে হতেই এক প্রত্যয়ী দৃঢ়তা পেয়ে যাই। আসলে আনন্দ যে আমাদের কর্মে ,চৈতন্যে, উপলব্ধিতে এবং সম্পর্কেও। আনন্দযজ্ঞে আমরা সবাই আমন্ত্রিত। সকলের জন্যই চরৈবেতি : “কে ডাকে রে পিছন হতে কে করে রে মানা, ভয়ের কথা কে বলে আজ ভয় আছে সব জানা।” মানব প্রবৃত্তির অমোঘ টান তো কখনোই অস্বীকার করা যায় না, তাই আনন্দযজ্ঞের শরিক হতে গেলে এই টান পেছন থেকে টেনে ধরে। বনের পাখির পানে এগিয়ে যেতে হয়। ‘ক্ষুদ্র আমি’র তখন মুক্তি ঘটে। পৃথিবীর মায়ামোহ সর্বদা আমাকেও ক্লান্ত বিষণ্ণ করে রাখে। দ্বন্দ্ব-সংশয়ে আবিষ্ট করে। এই দ্বান্দ্বিকতার বিচরণ থেকে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার কী উপায় ভাবতে ভাবতেই রবীন্দ্রনাথে সমাগত হই। যদিও দ্বান্দ্বিক দর্শনের ভেতর দিয়েই তিনি অগ্রসর হয়েছেন। পার্থিব ধর্মের আচার সর্বস্ব বিধিবিধানে তিনি কখনোই নিজেকে বন্দি করতে পারেননি। যে ঈশ্বরকে আত্মনিবেদন করতে চেয়েছেন সেই ঈশ্বর আদি-অন্তহীন মানব মহিমায় জাগ্রত, তাঁকে শুধু ধারণা করা যায়, উপলব্ধি করা যায় সৃষ্টির সংরাগে বিচিত্র রূপে। সে ঈশ্বর একান্ত ব্যক্তির ঈশ্বর হয়েও নৈর্বক্তিক, সাময়িক হয়েও আবহমানকালের চিরন্তন ঈশ্বর। আমরা এক একটি শূন্য বলেই মহাশূন্যের দিকে চলে যেতে চাই। শূন্যবাদ সেই বাউল ধর্মেরই অঙ্গ। নাস্তিক-আস্তিকতার বিচারে শূন্যবাদকে ব্যাখ্যা করা যায় না। শূন্যবাদ অস্বীকার নয় , আবার স্বীকারও নয়। কারণ শূন্যের একটা অবস্থান আছে। একটা ক্ষেত্রে তা বেড়ে ওঠে। সেই ক্ষেত্রটিই অবলম্বন। সংশয়বাদীরা কখন কোন্ দিকে তাঁদের বিশ্বাস বা ঝোঁক স্থাপন করবেন তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু শূন্যবাদীরা কোনো কিছু না থাকার ভেতরেও নিজস্ব রূপটি দেখতে পান তাতে নিজের কাছেই ঘুরে ফিরে আসা যায়। পার্থিব জগতে চরম অস্বীকার ধ্বংস থাকলেও আত্মিক জগতে সাময়িক হলেও নিজেকে স্বীকার করাই শূন্যবাদের মূল কথা। আর এর মাঝেই ক্ষণিকত্ববাদ জন্ম নেয়। রবীন্দ্রনাথ বাউল পন্থা থেকে যেমন ক্ষণিকত্বে আসা-যাওয়া করেছেন ,তেমনি আত্মগত ছায়া দ্বান্দ্বিক বা সংশয়েও উপবেশন করেছেন। আর শেষপর্যন্ত সহজিয়াতেই ফিরে এসেছেন। তাই তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’র গানগুলি আত্মনিবেদনের পথে হেঁটেও সংশয় এবং শূন্যবাদে আমাকে পৌঁছে দেয়। আর সেখান থেকে সহজিয়াতে নিয়ে আসে। ৫৩ সংখ্যক গানে তিনি লিখেছেন : “কী লয়ে বা গর্ব করি ব্যর্থ জীবনে। ভরা গৃহে শূন্য আমি তোমা বিহনে। দিনের কর্ম ডুবেছে মোর আপন অতলে, সন্ধ্যেবেলার পূজা যেন যায় না বিফলে। নামাও নামাও আমায় তোমার চরণতলে।” জীবন ব্যর্থ বলে মনে হলেও সেই ব্যর্থতা কিন্তু পার্থিব কারণে আসে না। নিজের অপূর্ণতা আত্মগত অপ্রাপ্তির কারণেই। আত্মা কী চায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানেন না, শুধু অপূর্ণতার বোধ কবিকে ব্যর্থতা উপলব্ধি করায়। কারণ গৃহ ভরা, কেবল কবিই শূন্য, অর্থাৎ পৃথিবী সংসার ভর্তি, হৃদয়ই শূন্য। দ্বন্দ্ব এখানেই ।জীবনের কর্ম চুকে গেছে। জীবনপ্রান্তে তার হিসেব নেই। শুধু আত্মিকশূন্যতায় আত্মনিবেদনের আয়োজন। তাই ‘সন্ধ্যাবেলার পূজা যেন যায় না বিফলে।’ ‘যেন’ অব্যয়টিই সংশয় নিয়ে আসে। শূন্যতার পরিধি ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিকে ফিরে যায়। সংশয় বা দ্বন্দ্বও বিস্তৃত হয়। কিন্তু পরবর্তী চরণে ‘নামাও নামাও আমায় তোমার চরণ তলে।’ লিখে কবি সেই সহজিয়া সমর্পণেই পৌঁছে যান। বাউল ধর্মে এভাবেই আত্মস্বরূপ নির্ণয় করে দ্বন্দ্ব-সংশয়ের পথ ধরে বাউলরাও আত্মনিবেদনে পৌঁছে যান : “গুরু দোহাই তোমার মনকে আমার লও সুপথে। তোমার দয়া বিনে তোমায় সাধি কী মতে।।” নির্ভরতা ও লক্ষ্য স্থির না হলে জীবন সাধনাও ভ্রান্ত পথে চালিত হতে পারে। কেননা প্রতিটি পদক্ষেপে আছে সংকট ও বাধা। লোভ-মোহ-মাৎসর্য। এসব থেকে বেরিয়ে এসে পরিশুদ্ধ আত্মস্বরূপকে পরমের কাছে নিবেদন করতে হয়। কিন্তু তা বড় কঠিন কাজ। এই কঠিনকেই বরণ করে নেন সাধকেরা। ‘মুক্তধারা’ নাটকের সংলাপেও রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রচলিত ধর্ম রীতি-নীতি শিক্ষা-দীক্ষা কতখানি অন্তঃসারশূন্য বাউল-সহজিয়া সাধকদের কাছে। কবি একটা ব্যঙ্গ ছুঁড়ে দিয়েছেন। পার্থিব বিষয়-আসক্তিতে ডুবে থাকা জীবনের লালসা রং এবং মৃত্তিকাময় সম্পদের মায়া এবং শাস্ত্র-বিধির বাঁধন কিছুই প্রয়োজনীয় নয়। সংলাপটি এরকম: ১। দেখেছিস ভাই, কী চেহারা ঐ উত্তরকূটের মানুষগুলোর ? যেন একতাল মাংস নিয়ে বিধাতা গড়তে শুরু করেছিলেন শেষ করে উঠতে ফুরসত পাননি। ২। আর দেখেছিস ওদের মালকোঁচা মেরে কাপড় পরবার ধরনটা ? ৩। যেন নিজেকে বস্তায় বেঁধেছে ,একটুখানি পাছে লোকসান হয়। ১। ওরা মজুরি করবার জন্যই জন্ম নিয়েছে, কেবল সাত ঘাটের জল পেরিয়ে সাত হাটেই ঘুরে বেড়ায়। ২। ওদের যে শিক্ষাই নেই, ওদের যা শাস্তর তার মধ্যে আছে কী ? ১। কিছু না ,কিছু না ,দেখিসনি তার অক্ষরগুলো উইপোকার মতো। ২। উইপোকাই তো বটে। ওদের বিদ্যে যেখানে লাগে সেখানে কেটে টুকরো টুকরো করে। ৩। আর গড়ে তোলে মাটির ঢিবি। ২। ওদের অস্তর দিয়ে মারে প্রাণটাকে ,আর শাস্তর দিয়ে মারে মনটাকে। অস্ত্র দিয়ে প্রাণ মারা আর শাস্ত্র দিয়ে মন মারার খেলা তো সারা পৃথিবীময় সব ধর্মের সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই মুখ্য হয়ে উঠেছে। ওইসব শাস্ত্রের অক্ষরগুলো উইপোকার মতোই ধ্বংস করে। শূন্যবাদের অনন্ত প্রবাহে এই ধ্বংস মিশে যায়। কিন্তু ভাবরূপের মরমিয়া দর্শনে সমস্ত নিয়ম-নীতির ঊর্ধ্বে এক সত্য বিরাজ করে। সেই সত্য কখনো ‘গুরু’ কখনো ‘মনের মানুষ’ কখনো ‘মুর্শিদ’। এই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই। এই জীবন-জীবিকার ভেতর ,এই রাষ্ট্র-সমাজের ভেতর সেই সত্যেরই অন্বেষণে ব্যাপৃত হই। নিজস্ব ঈশ্বরের আলোকে নিজেকে দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ এই পথেই আমাকে যাবার প্রেরণা দেন। তাঁর ‘গীতিমাল্যে’র ৪০ নং গানে সে কথাই ধ্বনিত হয় : “এই জীবনের আলোকেতে পারি তোমায় দেখে যেতে, পরিয়ে যেতে পারি তোমায় আমার গলার মালা সাঙ্গ যবে হবে ধরার পালা।” একটি জন্মই একটি জীবনের আলো, এই আলোতেই সত্যকে চিনে নিতে হয়, তবে আসে জীবনের পূর্ণতা। ‘ধরার পালা’ অর্থাৎ পৃথিবীতে জীবনরঙ্গ ও পার্থিব ক্রিয়াকর্মকেই কবি বুঝিয়েছেন। তারপর তিনি অনন্তের যাত্রী হয়ে যাবেন। শূন্যবাদ সেখানেই মিলিত হয়। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ক্ষেত্র থেকে তখনই কবি উত্তীর্ণ হলেন অসীম আনন্দলোকে । এই অসীম আনন্দই তো চিরসত্য। এই সত্য কখনো কখনো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পার্থিবের জটিল সংসর্গ ,ব্যক্তিসর্বস্ব ভোগ-বিলাসের হাতছানি রবীন্দ্রনাথকেও অপ্রয়োজনীয় করে তোলে। জীবন তখন বিষময় বিবমিষা ছাড়া আর কী ! ভাষা-ভাব-স্বপ্ন পাল্টালেও অনাদি জীবনের আকুলতা কি পাল্টায় ? পাল্টায় না বলেই কোনো না কোনোভাবে সত্যকে খুঁজতে হয়। এই সত্য অন্বেষণ একজন সাধকেরই কাজ। রবীন্দ্রনাথ কবিতা ,গান ,নাটকে এই সত্যেরই খোঁজ করেছেন। সত্য অরূপ সঞ্চারী ,সত্য উপলব্ধিময় ,সত্য কঠোর কঠিনও। পদ্ম ও শঙ্খের প্রতীকে কখনো তাকে উল্লেখ করেন। শেষ বয়সে পৌঁছে কবি এই সত্যকেই পুনরায় উপলব্ধি করে লেখেন : “রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম , শুনিলাম এ-জগৎ স্বপ্ন নয়। রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনার রূপ , চিনিলাম আপনারে আঘাতে-আঘাতে বেদনায়-বেদনায় ; সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা। আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ-জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।” আঘাত-বেদনায় সত্য কঠিন হয়ে ওঠে, কঠিনকে ভালবেসে সত্যকে লাভ করা যায়। জীবনভর দুঃখের তপস্যায় জীবনকে কাটাতে হয়, আর মৃত্যুতে এই সাধনার সমাপ্তি হয়। ‘আমি কে’ এই উত্তর কবি পাননি, চিরবিস্ময়ের অন্তরালেই তা থেকে গেছে। কিন্তু সত্যকে যে সারাজীবনের মূল্যে উপলব্ধি করতে পেরেছেন তা স্বীকার করেছেন ।এই সত্য রক্তের অক্ষরে, আঘাতে যন্ত্রণায় ফিরে এসেছে। কবিতা কল্পনা নয় ,ভাষা শব্দের কোনো রহস্যময় বুজরুকিও নয়, জীবনবোধের সীমানাতেই তার বিস্তার এবং প্রকৃত সত্য উদঘাটনেই নিয়ত যাত্রা—এই প্রজ্ঞা রবীন্দ্রনাথই দিয়েছেন। এই সত্য উদঘাটনের দায় যেন আমারও। কবিতা নাটক থেকে আমেরিকার চিঠিতে এসে উপনীত হয়েও রবীন্দ্রনাথের এই সত্যকে পাই “যে কামনা আগুন লাগায়, যে কামনা বিচ্ছেদ ঘটায়, তাহাকে তিনি ক্ষয় করিয়া ফেলিতেছেন। সেই অগ্নিদগ্ধ কামনার সমস্ত কালিমা একটু একটু করিয়া ঐ তো বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে ; যতদূর দেখা যায় একেবারে সাদায় সাদা হইয়া গেল, শিবের সহিত মিলনেও কোথাও আর বাধা রহিল না। এবার যে শুভ পরিণয় আসন্ন, আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডলের পুণ্য-আলোকে যাহার বার্তা লিখিত আছে এই তপস্যার গভীরতার মধ্যে তাহার নিগূঢ় আয়োজন চলিতেছে।” সত্যের যে শিবের মিলনেই সার্থকতা সেই সত্য-শিব-সুন্দরের সাধনাই রবীন্দ্রনাথ করেছেন। এই সত্য-শিব-সুন্দরই কি সাহিত্য নয় ? ব্যক্তি জীবনে যে উত্তরণ আমি বারবার চেয়ে এসেছি, রবীন্দ্রনাথকেই তার পরিপূরক মনে হয়েছে।যে Time ও Space মহাশূন্যে অনন্তযাপনে আমাকে হাতছানি দেয় তা শূন্যতারই কোনো অবস্থান থেকে আসে। আত্মগত উত্তরণ না এলে বস্তুপৃথিবীর ভ্রান্ত মায়াবী আলোকের জাল কখনো ছিন্ন করা সম্ভব নয়। আর তা সম্ভব না হলে সত্যকেও দারুণ মূল্যে লাভ করা যায় না। মৃত্যু আলো নয়। জীবন আলোর বিন্দুমাত্র। এই আলোকবিন্দু একসময় অন্ধকারেই মিশে যায়। এই মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটিই অনন্তকালের চিরন্তন নিয়ম। জীবনের পথটুকু থাকে ব্যাকুলতায় ভরা। একখণ্ড নারী, প্রেম-ভালোবাসা এক এক ঝলকে উদ্ভাসিত হয় , কিন্তু তা চিরন্তন নয়। অবশ্য তারই পথ ধরে পৌঁছে যেতে পারি বৃহত্তর প্রেম ও ভালোবাসায়। যে রূপ দেখে সুরদাস প্রার্থনা জানান কামনার তৃপ্তির , সেই রূপ দেখেই আবার অন্ধ হবার প্রার্থনাও জানাতে পারেন। একইসঙ্গে স্ববিরোধী চেতনা যা দ্বান্দ্বিকতায় পৌঁছে দেয়। জীবনরহস্যের কত বিচিত্র মোচড়। কত অবলীলা প্রকাশ। কত দুর্বোধ্য গতি রবীন্দ্রনাথ আজও যেন লিখে চলেছেন। শত শত বৎসর পেরিয়ে এসেও একই রাস্তায় তাঁকে পেয়ে যাব। অনন্ত রবীন্দ্রনাথ হয়ে তিনি থেকে যাবেন।

                   

By Chittaprosad Bhattacharya

পারমিতা ভট্টাচার্য

আমাদের,অর্থাৎ আশির দশকের শুরুতে যাদের শৈশব কেটেছে, ছেলেবেলাটা ছিল যেন রূপকথা!স্কুলে অযথা চাপ নেই, বাড়িতে টিভি নেই, ছিল সবরকম বই পড়ার অবাধ স্বাধীনতা। সবুজ মাঠে হা ক্লান্ত ছোটাছুটি কিংবা বঙ্গলিপি খাতায় লেখা পত্রিকা প্রকাশ—এসব ছিল নিত্যকার উৎসব। এছাড়া বাড়িতে অতিথিসমাগম হলেই তখন বিছানায় বিচিত্রানুষ্ঠান মাস্ট।অংশগ্রহণে আমি, ঝুমা, বুলান, শুভ, বুবাই—খাটের ছত্রিতে ঝুলত মায়ের শাড়ির পর্দা …

সেবছর কোনো কারণে পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে না। প্রতিভাস্ফূরণের এমন সুযোগ হাতছাড়া—ছোটরা ঘোরতর হতাশ! অদম্য আমি ও বন্ধু ঝুমা সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজেরাই করব রবীন্দ্রজয়ন্তী। মঞ্চস্থ হবে নাটক “নকলগড়”,আমরা (ফাইভ ও সিক্স)দুজন নির্দেশক।
কাস্টিং? সৌম্য (থ্রি ) চিতোররানা, শুভ (টু )কুম্ভ, পপি আর ছুটি (ফোর ও টু )মন্ত্রীদ্বয়। নেপথ্যের বাণী ও মিউজিকে দিদিভাই (নাইন)। আলোকসম্পাতে (টর্চে লাল/হলুদ সেলোফেন পেপার জড়িয়ে )বিজ্ঞ দুই পরিচালিকা।
ব্যস, হইহই করে চলল রিহার্সাল, যথাসময়ে নিমন্ত্রণ করা হল পাড়ার সব্বাইকে। বড়রা স্নেহভরে সম্মতি দিলেন, আমল দিলেন কম।

এল পঁচিশে বৈশাখ। বাবার পড়ানোর ঘরের একদিকে শতরঞ্চি বিছিয়ে মঞ্চ, দর্শকরা বসবেন চকচকে লাল মেঝেতে।ছবির রবীন্দ্রনাথ চন্দন আর বেলফুলের মালা পরেছেন, ধূপ জ্বলেছে।অভিনেতারা সাজপোশাক পরে, কাজল পেনসিলের গোঁফ এঁকে,প্রচুর পাউডার মেখে রেডি।সন্ধে হতেই পাড়ার কাকু, কাকিমারা হাজির।উদ্বোধনী সংগীতে যথারীতি দিদিভাই, তারপরই নাটক—

“জলস্পর্শ করব না আজ”… কাচ বসানো বাসন্তীরং কুর্তি ও লাল পাজামায় চিতোর রানার সে কী হুঙ্কার ! মাথায় আবার লাল ওড়নার পাগড়ি, হাতে মেলায় কেনা কাঠের তরোয়াল। সাদা চুড়িদার কুর্তি পরা মন্ত্রীরা হায় হায় করে ওঠেন “কী প্রতিজ্ঞা হায় মহারাজ, মানুষের যা অসাধ্য কাজ..” অভিনেতাদের ওপর লাফিয়ে যাচ্ছে হলুদ সবুজ আলো.. মন্ত্রীদের যুক্তি অনুসারে রাতারাতি তৈরি হল মাটির কেল্লা (আগে থেকে রেডি করা একটি গোবদা পাশবালিশ)!
এরপরে রে রে করে এল আমার ভাই —হারাবংশী বীর কুম্ভ… মালকোঁচা ধুতি,সাদা স্যান্ডোগেঞ্জিতে আলতার ছোপ, কাঁধে চড়কের মেলা র তিরধনুক, মাথায় ময়ূরের পালক…একাই সে রক্ষা করবে নকল বুঁদিগড়!! কুম্ভ যখন প্রাণ দিল, সেলোফেন জড়ানো জোড়া টর্চের আলোয় মঞ্চ লালে লাল… ব্যস, নাটক খতম। হাততালিতে ফেটে পড়লেন দর্শকরা !
কী কাণ্ড,জানলার গ্রিলের বাইরে দেখি ইতিমধ্যে অনেক কৌতূহলী মুখ, উঠোনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন পথচলতি দর্শকরা…

যা ছিল কয়েকটি বালকবালিকার প্রয়াস , এইবার তা হয়ে উঠল সর্বজনীন। দীপাকাকিমা উঠে এসে হারমোনিয়াম ধরলেন, একে একে গাইল তাঁর ছাত্রীরা— রিঙ্কুদিদি, বনুদিদি, খুকুদিদি।বাধ্যত আমরাও। তবলায় কিঙ্করকাকা।মনুদিদি বাড়ি থেকে নিয়ে এল গিটার, না সেজেই নাচ করল পুতুল,বাবুন—(ভর গ্রীষ্মরাতে ‘মেঘের কোলে রোদ ‘)!বাপি, অভি, আলো তিনজনে আবৃত্তি করল— (প্রথম ও দ্বিতীয়জন একই কবিতা “প্রশ্ন”), কিছু না কিছু করতে চায় সবাই!…সময় চলছে…হাতে হাতে ঘুরছে লুচি, আলুরদমের প্লেট, মা সারা দুপুর ধরে বানিয়েছেন…

রাত পৌনে এগারোটা… অনুষ্ঠান শেষের পথে , ঘুমঘুম চোখ পূর্ণতার গর্বে টানটান !তাই দেখে ছবি থেকে মুচকি হাসছেন রবীন্দ্রনাথ…’কী, কেমন মিলিয়ে দিলাম সবটুকু’!
বমমা তখন তদ্গত হয়ে গেয়ে চলেছেন শেষ গান —
“তোমার মাঝে এমনি করে, নবীন করে লও হে মোরে ,
এই জনমে ঘটালে মোর জন্ম জনমান্তর, সুন্দর হে সুন্দর.… “

                   

By Atul Bose

কুমারেশ তেওয়ারী

পূর্বাস্য হয়ে বসে আছেন তিনি। যেন এক প্রাচীন প্রাচীনতম ঋষি, মহা প্রজ্ঞাবান, রূপ ও অরূপের মাঝে তার অনন্ত তরণী ভাসাবেন বলে ভাব সমুদ্রের থেকে মুঠো মুঠো তুলে নিচ্ছেন লবণাক্ত জল। বিমূর্ত সেই জলের ছোঁয়ায় শরীরে উদ্ভাস এলেই ডুব দেবেন তার সৃষ্টির অতলে।
সৃষ্টির কথা ভাবতে ভাবতেই সূর্য উঠল আকাশে।তার আশ্চর্য রোদ ও আলো এখন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে জাগতিক সৃষ্টির সম্ভার। ধান ক্ষেতে কান পেতে শুনে নেবে কতটা জমেছে দুধ কায়াকল্পে তার। শিকার প্রত্যাশী আল সাপটির বিষ দাঁত ছুঁয়ে দেখে নেবে এখনও কতটা বিষ রয়ে গেছে তার নিজস্ব থলিতে। তাকে কি কোন ভাবে শোনানো যেতে পারে অমৃতের কথা?

ভাবতে ভাবতে রোদ সরে যায় অন্ধ পিয়ানো বাদকের দিকে। তার আঙুল ছুঁয়ে দেখে নেবে আঙ্গুলে আঙ্গুলে তার মাখামাখি হয়ে আছে সপ্তসুর? অন্ধ মানুষের ভেতরে একদিন অকস্মাৎ যে আলো জ্বলে ওঠে সেই রহস্যকে ধরার তাগিদে বসে থাকবে কিছুক্ষণ পিয়ানোর রিড ছুঁয়ে। যদি কিছু পেয়ে যায় অরূপরতন।

এমন দৃশ্যটি দেখে বিষণ্ণ মুখের রবি কবি আরবার কান পাতবেন সহস্র কোটি পদশব্দের ধ্বনি ধরে রাখা আমাদেরই এই পৃথিবীর নরম মাটির বুকে। খড়িফাটা উলঙ্গ পায়ের শব্দ তুলে যারা হেঁটে গিয়েছিল অথবা এখনো হেঁটে যায় এ মাটির বুকে, তারা কেন একবার দাঁড়াল না এসে তার সৃজনের কাছে? ছন্দময় অক্ষরলিপির কাছে! স্বপ্রশ্নে ক্রমশ বিষণ্ণ হবে কবির চোখ। তিনি তো চেয়েছিলেন মাটির কুটিরে রুগ্ন মায়ের চরণস্পর্শ নিয়ে, লাঙ্গলের মুখে স্নেহার্দ্র চুম্বন রেখে, শ্রমিকের চোখের ভেতরে মৃতপ্রায় স্বপ্নের বুকে পালক বুলিয়ে দিক তার অক্ষরলিপিরা।

ওগো প্রাজ্ঞ ঋষি, এ দোষ তোমার নয়, আমাদের, আমরাই চেয়েছি শুধু গাভীটির অমেয় দোহন। চেয়েছি কেবল পাত ভর্তি ক্ষীর। চাইনি কখনো ওরাও পাক অক্ষরের পাত থেকে শিখে নিতে তুলে নেওয়া ব্যথার প্রলেপ।

গীতাঞ্জলি নিয়ে গিয়েছে কি কখনও আমরা লাঙ্গলের কাছে? হাতুড়ির গায়ে বুলিয়েছি অক্ষর প্রলেপ? পাতাকুড়ুনির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গানের অমোঘ কলি বলেছি কি,এই নাও যাপনের আশ্চর্য প্রদীপ। বরঞ্চ আরও আরও কুক্ষিগত করেছি তোমার ওই সৃষ্টির সম্ভার। ভেবেছি এ কেবল আমার, আমাদের। ওপরচালাকি দিয়ে দেখিয়েছি, আমাদের চেয়ে আর বড় বোদ্ধা নেই।

অভিমানী ওরা ক্রমাগত সরে গেছে দূর থেকে দূরে। প্রজন্মের কাছে তুলে দিতে পারেনি বলে, কীটদষ্ট মন ভুলে গেছে রবির প্রকাশ। জেনেছে কেবল, যেখানে জাহাজ থেকে সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হয় ঘোড়াদের, সভ্যতা তার নাম রেখেছে উত্তমাশা অন্তরীপ।

Bust by Ramkinkar Baij