১
হেমন্ত নিভৃতিবাহী, মৃত্যু-অনুষঙ্গময়, গাঢ়।
যে ঋষি রচনাকাল ভুলে গেছে,
তার বিস্মৃতির মতো অমায়িক দীর্ঘ ছায়া ফেলে সে দাঁড়ায়
আমাদের ব্যবহৃত ব্যবহার্য ধার্য উঠোনের মাঝখানে।
খড়ি-ওঠা হাতে পায়ে গায়ে তার
বিদায়ী উৎসবের শব-ঢাকা চাদরের শ্বেত।
ফেলে আসা ঊনকোটি পূর্ণিমার ক্লান্ত হিম ধারাবাহিকতা
যেটুকু সবুজ চিনেছিল রাতে কালচে শ্যাওলার মায়ামাখা,
ঈষৎ বিবর্ণ মুখে তারই রেশ ধরে রাখা হালকা তারল্য।
অতীত আখ্যানকার একেই নিসর্গ বলে চালিয়েছে─
তলানি তেলের বাতি যেরকম দপদপে শিখা নিয়ে তার
ন্যূনতম অহংকার রাখে না অন্তরে,
হাওয়ার শরীরে হাওয়া যেমন সহজে মিশে যায়,
শোকসভা যেভাবে ইঙ্গিতে বোঝে নীরবতা কত স্থায়ী হবে,
আখ্যানের বর্ণিত নিসর্গ ঠিক তত অনায়াসে
চিনে নিতে পারে নিজ ঘেরাটোপ, অধিকার-সীমা।
এই পেরে-ওঠাটুকু মানবের জয়;
বাদবাকি যত অক্ষমতা
ধরা থাকে অভ্যাসের যত মূঢ় অর্থহীনতায়,
সব জুড়ে আবাহন অলীক নিভৃতিবাহী গাঢ় হেমন্তের।
২
আবাহন এমনই তো,
আলোকে আঁধারে নীত─
ডুবে গেলে দিনমণি, মনস্তাপে পুড়েছে যামিনী।
আঁধার গভীর হয়
পূর্ণ হলে অপচয়─
তরলা তটিনী তবু কত সুখে সমুদ্রগামিনী!
এই রীতি নিরঞ্জন─
অনধিকারের মন
খুঁজে ফেরে সর্বনাশ মিলনে আশ্লেষে উৎসবে।
সমাপন সন্নিকট─
বোঝে সে বিপন্ন বট,
গুরুভার ঝুরি তার মনোনীত বিষাদবৈভবে।
৩
অঘ্রানে সুদীর্ঘ ধীর উপক্রমণিকাখানি সেরে
মোহিনী মায়ার যদযাবতীয় নিয়তিনির্বন্ধ বুঝে নিতে নিতে
এমনই নিশ্চুপ তার আদি পদপাত─
অক্ষর চেনার মতো সাবধানে
যেমন বিবাহরাতে পুরুষ বৃক্ষটি কাছে টেনে নেয়
কিশোরী তরুর যত সনাতন বাহ্য ছলাকলা─
যা ছাড়া মুহূর্ত মিথ্যা,
যা বাদে অনন্ত মূঢ় ছকে বাঁধা ন্যায়ের নির্মাণ─
এমনই নিশ্চুপ আর এতদূর গতানুগতিক তার পুনরাগমন।
কোন স্বাভিমানে তাকে ছায়াবান ত্যাগী হতে চেয়ে
প্রতিটি ঋতুর কুঁড়ি অবহেলাভরে
ঝরিয়ে ফেলতে হল
কোনও প্রণিধানযোগ্য প্রসবের প্রহর না গুনে─
যা বিহনে অমরত্ব তুচ্ছ প্রহেলিকা আর
নেহাতই সমাপ্তিহীন অলাতচক্রের অভিরুচি─
সহস্র সম্পন্ন অভিধানে তার ব্যুৎপত্তি লেখা নেই কিছু।
যে ঋষি রচনাকাল ভুলে গেছে,
তার কাছে ছায়ার কাহিনিখানি বুনে চলা
শুধু অর্থহীন নয়,
ক্রুর নিষ্ঠুরতা।
৪
নিষ্ঠুরতা আদি সত্য─
সৃষ্টির শাশ্বত নিয়ামক,
মহাপ্রাণ,
অমোঘ ব্যবস্থাপক,
সহোদর ধ্রুব অনুগামী।
দেখো,
চোখ মেলে তাকাও ওই পলিত পশ্চিমে─
যেখানে আকাশ কেমন ধীরে,
খুব ধীরে,
পূর্ণতায় পুরোপুরি ঢালু হয়ে
অভিবাদনের ভঙ্গিতে রূপধরা প্রণতির প্রাচুর্যে প্রাচীন─
ওই মুগ্ধ পরবাসে
পুরনো বন্দর থেকে এইবার
তার সমূহ আনুষ্ঠানিকতার লটবহর নিয়ে
ছেড়ে যাবে অন্তিম জাহাজ,
যার সাবেক অন্তরে কখনও কোনও মায়া ছিল না,
অধুনার কোনও পিছুটানও স্বীকার করবে না বলে যে
প্রতিশ্রুত ও বদ্ধপরিকর।
ছেড়ে যাবে সেই জাহাজ,
পোয়াতির মতো রূপরসগন্ধময়
আশ্চর্য সম্পন্ন সেই অন্তিম জাহাজ
এবার ছেড়ে যাবে বন্দর,
ঠিক যেমন যতিচিহ্নকে ছেড়ে যায় পরবর্তী উচ্চারিত বাণী।
ওঠো, কান পাতো,
তুমি কি শুনতে পাচ্ছ মারণ সাইরেন?
খসে পড়ছে নিয়তির প্রেত ছদ্মবেশ─
তুমি কি দেখতে পাচ্ছ তাও?
সুসজ্জিত ব্যাঙ্কোয়েট।
সুবেশা ও সুবেশ নারী-পুরুষেরা প্রবেশ করছেন একে একে।
একটা আস্ত দেশ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে একটু আগে।
দেশ মানে বাজার।
প্রতিটি ছোট-বড় দেশ একেকটি ছোট বা বড় বাজার।
একটা আস্ত বাজার সবসুদ্ধ বিক্রি হয়ে গেছে।
আজি পরমোৎসবরাতি।
ছিমছাম পোশাক-পরা বেয়ারাদের হাতে হাতে
ঝকঝকে ট্রের ওপর সাজানো রক্ত-পানীয়ের পাত্র─
দশ বছরের যে শিশুকন্যাটিকে ধর্ষণ করে মেরে
টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়েছে খানিক আগে,
তার উষ্ণ শোণিতও মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই পানীয়তে,
যদিও তা জানতে দেওয়া হয়নি কাউকে,
কেননা আমরা মেনে নিয়েছি যে
রহস্যের চেয়ে রোমাঞ্চকর আর কিছুই নেই এই মরজগতে।
এবার গান শুরু হবে।
৫
আমি তোমার হাতে রেখেছিলাম অরণ্যবাস দেনা।
কই তুমি তো আর তেমন সুরে কখনও বাজলে না!
বাজলে না আর উদ্দামতা, বাজলে না আর জয়,
ঠিক যতটা বাজলে শোকও পরব মনে হয়।
ঠিক যতটা বাজলে আলো আঁধারপারা লাগে,
ঠিক ততটা বাজলে সুরে বিপন্নতা রাগে!
তবে এমনটাই কি হওয়ার ছিল, সত্যি করে বলো?
পুড়ে খাক হব না, শুদ্ধ হব অশ্রু-ঝলোমলো!
আমি নিজের হাতে রেখেছিলাম নশ্বরতা বাজি।
বলো এমন করে পোড়ালে তুমি আগুন হতে রাজি?
৬
হেমন্ত এমনই ধীর, দহনের মতো।
মৃদু তালবাদ্যে তার
দ্রিমিদ্রিমি দূরধ্বনি ভেসে আসে শুনে
কোনও হ্রস্ব ঝরনার কাছে গিয়ে বসে সব সফল নশ্বর,
কান পাতে,
যদি বিস্ময়ের চেয়ে আরও বেশি মায়াময়
কোনও অভিমান তার পসরা সাজিয়ে ডাকে:
আয়! আয়! আয়!
আয় মানে ঘন আবাহন।
আয় মানে সম্পদের ইশারাও, বুঝি।
সমূহ ক্ষয়ের পরে যেটুকু অমল ভাগশেষ
সঞ্চয়ের অদাহ্য ইঙ্গিত নিয়ে আসে,
তারই সহচর সেজে
সোনারঙ প্রাচীনতা বন্ধ জানলার বাহুডোরে
ইতিহাস ধরে রাখে মূক।
শীতের মেঘের মতো ঠান্ডা ও ধূসর যার মুখ,
হাড়-সাদা তরল জ্যোৎস্নায় তার প্রকম্পিত ভাসমান
একাকী দাঁড়িয়ে থাকা দেখে
রোমাঞ্চের অনুপুঙ্খ মায়া মনে পড়ে।
মনে পড়ে
গহন ইস্কুলবেলা ডুবসাঁতারের জল ভেঙে
ডাইভিং বোর্ডের নিচে এসে থম মেরে ঈষৎ জিরোত,
যেন সে কুহক ব্যাধ─
পাখিটিও শিকারী নিশ্চয়─
আলগোছে জেনে নেবে সমূহ দ্বিচারিতার সব ছলাকলা।
একটা জীবন খুব এলোমেলো কেটে গেল,
অন্যমনস্কের মতো─
পূর্ণ হলে আত্মপ্রতারণা,
এরকমই মনে হয় ঘুমঘোরে স্বকীয় ব্যথায়।
অনন্ত পোহালে পরও আয়ুর আকাঙ্ক্ষা কত, আহা!
যে মোহপল্লব কাঁপে আদিগন্ত নীলে,
ভীরুতার মোহন রূপকে তাকে আঁটিয়েছে সামাজিক মন─
এই ব্যর্থতার কোনও চারা নেই, প্রতিকারও নেই;
হেমন্ত জেনেছে সেই কথা,
হেমন্ত জেনেছে সেই অরন্তুদ লোকসম্মতির পরিণাম।
৭
হেমন্ত নিভৃতিবাহী, মৃত্যু-অনুষঙ্গময়, গাঢ়।
যে ঋষি রচনাকাল ভুলে গেছে,
তার বিস্মৃতির মতো অমায়িক দীর্ঘ ছায়া তার।
আমাদের ব্যবহৃত ব্যবহার্য ধার্য উঠোনের মাঝখানে
সেই তার পরম নিভৃতি।
জাগো ওম।
জাগো শ্রম।
জাগো জবাকুসুমসঙ্কাশ সন্ত্রাস।
জাগো ধর্ম।
জাগো প্রীতি।
জাগো চিরপরমতসহিষ্ণু সন্ন্যাস।
জাগো মিথ্যা।
জাগো ছল।
জাগো আত্মপ্রবঞ্চনাময় নশ্বরতা।
জাগো শান্তি।
জাগো ক্ষান্তি।
জাগো পরমন্তপ হেমন্ত অন্তরের পরম নির্বেদ।