মাটির কাছাকাছি , সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে বেঁচে থাকেন নির্মল হালদার। তাঁর কবিতা জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবন মহাকাব্য । জীবনের সাধারণ মুহূর্তগুলোর মধ্যেই তিনি অসাধারণকে খোঁজেন । নির্মাণের কসরত নেই , শীতে যেভাবে চন্দ্রমল্লিকা ফুটছে, সেইভাবেই তিনি কবিতা লিখছেন। মনে পড়ছে মিশেল ফুকোর ‘হিস্ট্রি অফ সৌল ‘ । কবির আত্মাই তো কবিতার আত্মা। বরাবরের মতো, টানাহ্যাঁচড়া না করে, জীবনকেই আলতো করে ছুঁয়ে আছেন নতুন এই কবিতাগুলোয় ।
…কবিতা আশ্রম
নির্মল হালদারের কবিতা
আমার শীত করছে খুব
১
কাঠকুট পাতপালা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে গ্রামের মানুষ। এই জোরালো শীতে।
আমার ছোটবেলাও ছিল আগুন পোহানো সন্ধে। আগুন পোহানো রাত। আমি ছিলাম তুলিনে। পাহাড় ও গাছপালা ঘেরা এক গ্রাম। তুলিন। সুবর্ণরেখার হাওয়া শিরশির করে ঘরে ঢুকে পড়তো। শীত করতো আরো আরো। আমরা ছোটরা গোল হয়ে আগুন পোহানো উপভোগ করেছি। গল্প শুনেছি রূপকথার।
তুলিনের সেই দিদি বাড়িতে দিদির এক বিধবা জায়ের উদ্যোগে একটা লোহার কড়াইয়ে আগুন জ্বালানো। ভুলেও যেতাম নিত্যদিনের লেখাপড়া। ঘরের কেউই বলতো না—-পড়তে বোস।
গায়ে একটা ফিনফিনে জামা। আর হাফ প্যান্টে কি শীত যায়! সেই মান্ধাতা আমলে পায়ে ছিল না মোজা। গায়ে ছিল না সোয়েটার।
নটা বাজতে বাজতেই কাঁথা ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়েছি। সেই কাঁথা আর দেখা যায় না। সারা গ্রীষ্মকালে মা দিদি বৌদি সেলাই করতো একটার পর একটা কাঁথা।
পুরনো ছেঁড়া কাপড় জোগাড় করে জমিয়ে রাখতো। শাড়ির পাড় থেকে সুতো বের করে সেলাই।
ওই সেলাই ওই কাঁথাও ছিল শিল্পকর্মের আরেক দিক। যা মেয়েরা সৃষ্টি করতো। এখানে আমি নির্মাণ বলতে চাই না। সৃষ্টি আর নির্মাণের তফাৎ অবশ্যই আছে। মেয়েরা সবসময় সৃষ্টি করে নিজের মত। মনের মাধুরী মিশিয়ে। ভিক্ষে চাইলেও সেই মাধুরী আর পাবো না।
শীতেই তো নতুন আলু পুড়িয়ে পুড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ হাসি মজা। ঘরের বাইরে। কোনো ধান জমিতে। অথবা মাঠে।
আগুনের অভাব ছিল না, এদিক ওদিক থেকে গাছের ডাল শুকনো ডাল এনে আগুন জ্বালানো। নতুন আলু পোড়া কী যে সুস্বাদু সেও তো আমার কৈশোরের স্মৃতি।
আজ তো কোথাও আগুন নেই। যে যার নিজের মতো করে বুকের আগুন নিভিয়ে কাজে কর্মে এবং সংসারে ব্যস্ত। শিল্প সাহিত্য ও রাজনীতিতে কোনো উন্মাদনা নেই। আছে শুধু নিজেকে বিজ্ঞাপিত করা। সমাজ–মাধ্যমে বারবার প্রকাশ করার মধ্যেই গৌরব প্রকাশ করা।
আগুন আর প্রকাশ করবে কোথায়?
যৌবনের দুয়ারে দুয়ারে আগুন ভিক্ষা করতে গেলেও আমার দুহাতে আসবে অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য। ছাই দেবার মত আজকাল উনুনও নেই। ওভেন তো কয়লা পোড়ায় না। গ্যাস পোড়ায়।
সমস্তই তো গ্যাসে চলছে।
অনুভূতিরা অসাড়। অনুভবে শুধু মোবাইলের রংবেরং। আমার তাই সন্দেহ, শীত সবার করছে না।
হাড় মাংস তো নেই শুধু কাঠামো। মানুষের একটা কাঠামো। তবু কাঠামোর কাছেই মান্ধাতা আমলের একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে অজিত পাণ্ডের একটি গান—–
জাড়ে কাঁপছে আমার গা
জাড়ে ক্যানে কাঁপিস বহু
আগুন পুহা যা —
—–১৯ পৌষ ১৪৩১
—–৩—১—২০২৪
—–নির্মল হালদার
২
বয়সে তরুণ । দেখে মনে হয়। সারাদিন খালি গায়ে একটা হাফপ্যান্টে ঘুরে বেড়ায় সারা শহর।
প্রবল শীতেও এই রাস্তা ওই রাস্তা এই গলি থেকে ওই গলি একা একা ঘুরে বেড়ায়। খালি গায়ের একলা পাগল।
তাকে দেখেই আমার শীত করতে লাগলো। মনেও হলো, একটা চাদর দিলে হয়! অথবা একটা সোয়েটার। পরমুহূর্তেই আমার ভাবনা—–যদি প্রত্যাখ্যান করে?
আবার এও ভাবছি, দিতে গেলে যদি আমারই জড়তা কাজ করে? দিতে গেলে যদি সে ছুঁড়ে ফেলে দেয়? তাহলে তো রাস্তার লোকজনের কাছে এক ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। হাসাহাসিও চারদিক থেকে আসতেও পারে।
এইসব ভাবনা থেকে বিরত হয়ে আরো ভাবছি, পাগলেরও তো শীত করছে খুব, নাকি করছে না? তাকে কখনোই চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেতে দেখিনি। কোনো হোটেল বা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে না কখনোই।
একলা পাগলের খিদে–তেষ্টা নেই? পিপাসা নেই? স্নান কি করে না? শহরে বাড়ি নাকি কোনো গাঁয়ে?
আলাপ করতে গেলে সব কি জানা যাবে? এখুনি জানা যাবে, তার শীত করছে কিনা?
সন্ধ্যেবেলার আলোছায়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ভাবনারা আমাকে জড়িয়ে ধরলেও আমার শীত করছে খুব।
পাগল যদি আমাকে জড়িয়ে ধরে? কার শীত কাটবে? নাকি কেউ কাউকেই জড়িয়ে ধরবো না?
আমার পথের উল্টোদিকে এক জনমজুর কাজ শেষে ঘরের দিকে। তাকে দেখেও মনে হলো, তার শীত করছে না। পিঠে ঘামের চিহ্ন। শরীরে উষ্ণতা বইছে।
ওই উষ্ণতায় স্নান করবে কে?
আমার স্নান সাত সকালে ।
আমার মা বলতো, আমি যখন স্নান করি তখন কাক কোনো খাবারে মুখ দেয়নি। অর্থাৎ মা বলতে চাইতো, পাখিদের সকাল হয়নি তার আগেই আমার ছেলের স্নান হয়ে গেছে।
তখনও কি আমার শীত করতো না? অতীতে শীত কি ছিল না? ছিল ছিল তবে আগুনের অভাব ছিল না। আগুনের আয়োজনও ছিল। মানুষের জন্য মানুষের লড়াই ছিল।
কবিতা থেকে মিছিলও ছিল। শিল্প থেকে শিল্পের উত্তাপ ছিল। ভালোবাসাবাসির আগুনে সেঁকে নিয়েছি আমাদের গা-হাত–পা।
ঝরা পাতা জড়ো করে আগুন পোহানোর মতো গাছপালা নেই আমার শহরে। কে আছে?
একটা শিরদাঁড়াও দেখছি না।
——২০ পৌষ ১৪৩১
——৪—১—২০২৪
——নির্মল হালদার