You are currently viewing সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম ১৫০ সংখ্যা

সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম ১৫০ সংখ্যা

—বিভাস রায়চৌধুরী



নতুন কবিতা উঠে আসছে নিয়ত। কারণ কবিতা অফুরন্ত। এই সংখ্যায় শিলচর থেকে সুতপা চক্রবর্তী, বনগাঁ থেকে কনক মণ্ডল, রাণীগঞ্জ থেকে রুমা তপাদার, শান্তিপুর থেকে ভাস্কর সুতার, বোলপুর থেকে শীর্ষা—এই পাঁচজন তরুণ কবি পাশাপাশি জ্বালিয়ে রেখেছেন তাঁদের নিজস্ব ধুনি। যে যার সাধনায় জেগে থাকো, তরুণ কবি!

কবিতার জন্য যতদিন জেগে থাকতে পারবেন কোন‌ও কবি, ততদিনই তাঁর হাতে থাকবে কবিতা। কবি হয়ে গিয়েছি ভাবলেই খেলা শেষ। মনে রেখো কবি ফুরোয়, কিন্তু কবিতা ফুরোয় না কখনও।


সুতপা চক্রবর্তী

সুতপা চক্রবর্তী

বাড়ির নাম কুর্চিফুল

     

১.

সুরেশ দাদু

সুরেশ দাদু অন্ধ। সুরেশ দাদু ঠেলাচালক। সুরেশ দাদুর ঘরে দ্বিতীয়া স্ত্রী, কন্যাশিশু। সুরেশ দাদুর বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সুরেশ দাদু সারাদিন ঠেলা চালান। সুরেশ দাদু সারাবছর আমাদের বাড়ির চাল বহন করেন। কুইন্টাল কুইন্টাল চাল আসে বাড়িতে। প্রতিদিন ডিবি ডিবি চাল যায় ডেগে। সুরেশ দাদু অন্ধ। সুরেশ দাদুর উনানও অন্ধ। সেখানে আগুন জ্বলে না। তিনবেলা খিদে জ্বলে। বাবা চাকুরি হওয়ার পর আমাদের বাড়িকে লুকিয়ে সুরেশ দাদুকে প্রতিমাসে কিছু পয়সা দিতেন। সুরেশ দাদু দু’হাত তুলে বলতেন, ‘ঠাকরব্যাটা তোমার নাও শুকনা বায় দি যাইবো।’ বাবার লজ্জা লাগত। আমার আরো বেশি লজ্জা লাগত। নাও আবার শুকনো যায়গায় চলে নাকি? নাও বাইতে জল লাগে। স্রোত লাগে। সুরেশ দাদু সত্যিই অন্ধ। কিছুই দেখতে পান না। নাও বিষয়ে কিছুই জানেন না। আমি আরো লজ্জায় কুণ্ঠিত হতাম। বাবা যখন লজ্জা পান আমারও লজ্জা পাওয়াই উচিত ওই মুহূর্তে। সুরেশ দাদু এখন আর নেই। আমি ও এখন আর শিশু নই। বাবার বয়স হয়েছে। আমি যুবতী। আমাদের বাড়িতে এখন আর কুইন্টাল কুইন্টাল চাল আসে না। সুরেশ দাদুর সাথে সাথে ঠেলারও মৃত্যু হয়েছে। বাড়িটিকেও এখন আর আমি খুঁজে পাই না। আমাদের বাড়িটিও হারিয়ে গেছে। নৌকো গেছে। জল গেছে। এখন আমাদের চারপাশ শুকনো খটখটে। অন্ধ সুরেশ দাদুর কথা সত্য হয়েছে। অন্ধ ঠেলাচলকের কথা সত্য হয়েছে। বৃদ্ধ ঠেলা চালকের কথা সত্য হয়েছে। অবলীলায় নাও চলে যাচ্ছে শুকনো রাস্তায়। আমার আর এখন লজ্জা করে না। শুধু মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ে বাড়ির কথা। কুইন্টাল কুইন্টাল চালের কথা। অন্ধ সুরেশ দাদুর কথা। শুধু মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ে।

খুব মনে পড়ে।

২.

নেউলি

নেউলির কথা এখন আর কারোর মনে নেই। নেউলি আমাদের ইস্কুলে এক ক্লাস উপরে পরত। নেউলির নাম নেউলি কেন তা কেউ জানে না। যেমন করে খাড়ল-এর নাম খাড়ল কেন এটা কারোর জানারই কথা নয়। অথচ সারা ইস্কুল তাদের নেউলি ডাকত। সারা ইস্কুল তাদের খাড়ল ডাকত। আমি বহুদিন ক্লাসে বসে বসে বেড়ার ফাঁক দিয়ে নেউলিকে দেখেছি। রুক্ষ শুষ্ক লাল চুল দেখেছি। হাফেনআওয়ারের আগে উঁচু জানালা দিয়ে ইস্কুল থেকে পালিয়ে যেত নেউলি। বহুদিন পর জেনেছি হবি মিয়া যিনি আমাদের বাড়ির সুপুরি পাড়েন তার মেয়েই আমাদের ইস্কুলের নেউলি।

হবি মিয়া আর নেই।

নেউলি এখন কেমন আছে আমি জানি না। 

নেউলি প্রতিদিন জানালা দিয়ে ইস্কুল পালাত। নেউলির আর পড়াশোনা হয়নি। নেউলি ক্লাস সেভেন পাশ হয়ে ঘুরছে। চক্রাকারে ঘুরছে। কোথায় ঘুরছে কে জানে! 

হায়, নেউলি কোথায় ঘুরছে কে জানে!

কে জানে।

৩.

আমি কেন বড় হলাম? না না আমার শরীর কেন বড়দের মতো হল! অথচ ভেতরে ভেতরে আমি ছোট রয়ে গেছি। ভেতরে ভেতরে আমি শিশু রয়ে গেছি। এ নিয়ে আমার অশান্তির শেষ নেই। দিন রাত অশান্তি করি। বাড়ির সাথে এখন আমার দীর্ঘ আড়ি। দীর্ঘ দীর্ঘ আড়ি। বাড়ি আমায় ভুলে গেছে। কুর্চিফুলের দেশে গেছে। বাড়ির ভেতর কুর্চিফুল। ভুল ভুল। বাড়ি আমার মস্ত ভুল।

বাড়ি আমার ছোট্ট ভুল

বাড়ি আমার কুর্চিফুল

মস্ত ভুল।

মস্ত ভুল


কনক মণ্ডল

কনক মণ্ডল

ধ্বনি

ভিজে আছে পাতা পুষ্প বৃন্ত
ভিজে আছে কান্না
আরও গাঢ় আরও গাঢ়।
পাহাড়ের মুসাফির নেমে আসে
আরও কাছে আরও পাশে।

বলো, কতটা হিংস্র হলে
তোমার গোপনীয়তা আমাকে কাঁদাবে!
যারা ক্ষত করে গেল
তাদেরকেও বলি—কাঁদো
অপরাধের চিহ্ন নিয়ে,
ভালবাসার বিরহ নিয়ে।

তোমাকে ক্ষত মুছিয়ে
বিষ ঝেড়ে জীবনের
পথ খুঁজতে চাই না।
তীব্র ঝরে পড়া ক্ষত
আমি কাঁধে নিয়ে নেমে যাব
ঝরনার তলে, তরলে…
কুহক থাকবে না, থাকবে না
পরিকল্পিত মৌ-পথ,

শুধু,
ধ্বনি থাকবে হৃদয়ে হৃদয়ে…

আরও একটু পুড়তে হবে

চুপ! ঘূর্ণিঝড় এসে গেছে—
এবার কিছু একটা করে ফেলব।
তোষক কিনেছি,
খাটে বিছিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি এসো।
আজ বিশ্রাম, কাল আবার
সারিবদ্ধ প্রজাপতি হত্যা দিয়ে
হাত লাল করে নেব।

আরও একটু পুড়তে হবে
নাহলে সমাজ আমাদের
মানবে কেন?
শব্দ করে ছিঁড়ে ফেলতে হবে
তোমার জরায়ু।

তবু যে হেরে গেলাম গর্ভবতী মৃত মায়ের তলপেটে।

আরও দুঃখী প্রমাণ করতে হবে?
আরও নাড়িছেঁড়া রক্তে স্রোত দিয়ে
বোঝাতে হবেই আমি নুলো, ভিখিরি নই!
আমরা কি কাক হয়ে যাব
বুঝব না কোকিলের বিদীর্ণ বিষাদ?

আলো হাতে কালো পথে ছুটে চলে হিংস্র মৃত জাত,
আরও একটু পুড়তে হবে, পোড়াতে হবে হাত

রুহু


শৃগাল ঘুমিয়ে গেলে তুমি জেগে ওঠো,
এবার যাবার পথ তৈরি —
কবিতা শুনিয়ে আসব প্রিয় জন্মভূমি।
আমার এপারে লেখা প্রেমের কবিতা
তোমাকে দেব, তুমি নিয়ো
মনে রেখো, তুলে রেখো
ধ্বনি বক্ররেখা।

শৃগাল ঘুমিয়ে গেছে?
সকিনা বাতাস বয়ে যাচ্ছে কুঠিরের জানলা দিয়ে
কেউ তাকে ধরুক বা না ধরুক—রুহু নিয়ে সে ছুটেছে।
তুমি দেখিয়ে দেবে না
খই বাবলার আলপথ?

মায়ের স্মৃতির কাছে



অনেক কান্নার জলে পান্তাভাত হয়ে
খিদের অক্ষরে লিখে দিয়ো ধনুকের ছোরা।

মা ভুলে যাচ্ছে সকল প্রিয় দিনের কথা
আমি অনাথ হয়ে পড়েছি
মায়ের স্মৃতির কাছে,
প্রিয় ঘর, ঘনঘোরে ঘুরে চলে…
কাকে বলি এই কান্নার জল, পান্তার কথা?


শীর্ষা

শীর্ষা

চারটি কবিতা


মৃত মানুষের মুন্ডু নিয়ে দৌড়ে বেড়াই
আমরা— এদিক-ওদিক, এপাশ-ওপাশ,
আর চারদিকে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে পৃথিবীর কান্না—
কেউ যেন সমস্ত গরল বের করে আনছে
পৃথিবীর তলপেট থেকে; বাসুকীর মতো
তার লম্বা শীতল শরীর হিসহিস করছে,
চোখ রাঙাচ্ছে গাছ-পাখি-আকাশ-বাতাস-মাটিকে
চারিদিকে ত্রাহি ত্রাহি ঘণ্টাধ্বনি, হাউ হাউ শঙ্খধ্বনি!
মৃত মানুষের মুন্ডু নিয়ে ফুটবল খেলছে,
খেলেই চলেছে
আরেক মৃত মানুষের দল— এ ওর পায়ে,
ও এর পায়ে! গর্ভবতী বেড়ালের তীক্ষ্ণ কান্না হয়ে
বেদনার বীজ ছড়িয়ে পড়ছে আনাচে-কানাচে—
যার সর্বত্র মানুষ শুধু, মানুষেরই দল—
হিংস্র মানুষের দল,
পাথর মানুষের দল,
মৃত মানুষের দল,
অনুভূতিহীন মানুষের দল
গোরস্থানে বদলে দিচ্ছে পৃথিবীকে।


রাস্তার ধারে একটি কুকুর কুণ্ডলী হয়ে
শুয়ে থাকে— তার শুয়ে থাকায় আমি
ভাস্কর চক্রবর্তীকে খুঁজে পাই, যে-ভাস্কর
আমার সাথে হ্যারিকেন হাতে জীবনদর্শন
খুঁজতে বেরোন মাঝে মাঝে;
তার শুয়ে থাকায় আমি সেই সাপটিকেও
খুঁজে পাই— গরল ও অমৃত দুইয়ের প্রতিই
একদা যে সমান আসক্তি দেখিয়েছে;
তার শুয়ে থাকায় আমি খুঁজে পাই একলা
রুটির মতো ফ্যাকাশে একটি দুপুরকে,
যার বুক চিরে শুধুই হাওয়ার হা হা গোঙানি,
উষ্ণতার পারদে লেগে থাকে শুধুই জীবের কান্না।
এভাবেই রাস্তার ধারে কুণ্ডলী সেজে শুয়ে থাকা
একটি কুকুর আমার কাছে জীবনদর্শন হয়ে ওঠে,
বিরক্তিকর সরীসৃপ হয়ে ওঠে,
নিঃসঙ্গতার আধার হয়ে ওঠে।
হঠাৎই আমি আশ্চর্য হই।
দেখি হ্যারিকেন নিভে গেছে,
অমৃত-গরলের থলিটি স্থির,
পৃথিবীর কান্নাও শব্দ হারিয়েছে।
ভীষণই আশ্চর্য হই সহসা—
দেখি রাস্তার ধরে শুয়ে থাকা কুণ্ডলী কুকুরটির ছায়ায়
ধীরে ধীরে আমি নিজেকেই
খুঁজে পাচ্ছি


পৃথিবীর প্রগাঢ় ছায়াটির থেকে উঠে আসে ঘুম,
উঠে আসো তুমি। গভীরতম ছায়ার মণিকোঠায় গিয়ে
জমা হয় জাগতিক যত বিষাদবিলাস,
শোক-দুঃখের মণিহার। চারিদিকে শুধু
ঝমঝম বৃষ্টি, আর বৃষ্টিই যেন—
চঞ্চলা হরিণী নূপুর পায়ে ছুটে চলে যায়;
তার ইতস্তত পায়ের রিনরিনে আরও গভীরে
চলে যায়, আরও চাপা পড়ে তোমার সপ্রেম
বেদনার ঝুড়িটি। যীশু হাসে, বুদ্ধ হাসে,
তুমি দেখো, দেখতে পাও— রামকৃষ্ণের হাসিটিও।
দেখতে পাও এইসব হাসি ফুঁড়েই
ছায়াটির থেকে তুলে আনা যায় পরমহংস
সেজে বেড়ানো মানুষের সমস্ত নিজস্বীগুলিকে,
ঘুমের আতর মেখে যারা চাপা পড়ে থাকে
সাদা সাদা ফুলের পাঁজরের নীচে


মাঝে মাঝে মনে হয় একেকটি স্তূপের কাছে বসে থাকি। নিশ্চুপ। একটি নৈঃশব্দ্যের কুকুর এসে আমাকে ছিঁড়ে
খাক। পান করুক আমার রক্ত। অভিমানের সোমরসে যা কালো হয়ে গেছে। জমাটবাঁধা মেঘের মতো। কুকুরের
লালার তীব্রতা চাটতে থাকুক আমার একাকী আত্মাকে। আমার শব্দহীন বোধকে। এভাবেই আমি পাথর হয়ে
উঠি। প্রবল শব্দ করতে চাওয়া নিঃশব্দ কোনো পাথর। পরতে পরতে যার বিষণ্ণতার ধুলো। বিষাদের কণা।
এভাবেই আমি স্তূপ হয়ে উঠি। নৈঃশব্দ্যের কুকুর যাকে চাটতে ভালোবাসে। নৈঃশব্দ্যের কুকুর যাকে নিজের করে
নেয় তার দ্বিধাহীন হিসি দিয়ে।


রুমা তপাদার

রুমা তপাদার

ঘামের সোহাগ


এখানে আকাশ শুধু ধোঁয়া ধোঁয়া
পৃথিবীর গর্ভ থেকে হাঁ করে অন্তত অভিমুখে চেয়ে আছে অন্ধকার
ভাঙনের পরে দিয়ে যাবে অবশিষ্ট আলো
নেমে যাওয়ার ডাক আসে
প্রাণ হাতে নেমে যায় প্রাণের পুরুষ কত কত
উঠে আসে দেহে মেখে কালি-ধুলো
মাঝেমধ্যে কত কত নটেগাছ আচমকা সফল মুড়োলো


নক্ষত্র ভেঙেছে সেইদিন।
চাল চাপা পড়ে গেছে ফনি বাউরির মাথায়
রে রে লোকজন হৈ হৈ ছুটে আসে,
ট্রেডের নেতার গাড়ি ম্যানেজমেন্ট বুঝে গেল সঙ্গে লোক আছে
আজই প্রভেনসিয়াল মৃত্যু-কান্না গলিতেই পড়ে থাকে
যে নক্ষত্র ভাঙে সে একাই ভেঙে যায়!
নিয়মে পৃথিবী ঘোরে ভাঙনের চারিধারে
তার গুঁড়ো নিয়ে বাকিরা সামিল হয় নতুন নক্ষত্র আগুনের চূড়া
যতদিন শরীরে যৌবন থাকে ধারে-কাছে থাকে স্বামীর বন্ধুরা..


আগুনের খোঁজে নীচে নেমে গেলে
আলোতে আলোতে আশ্বাস নদী
ধুলো আর ধুলো ছাই মিশে আছে
ঝামেলা ঝগড়া চলে নিরবধি

কে কার আপন কে যে কার পর
হাতে রাখা আছে গাঁইতি শাবল
হাওয়ার খুশবু লোফালুফি চলে
বৃষ্টি মানেই কাদা-কাদা জল

পা ডুবে যাওয়া ওসিপির লোক
বর্ষা বৃষ্টি বিরক্তিকর
এত পিচ্ছিল ভয় লাগে যেতে
নাগা করে ওরা হ্যাঁ পরস্পর

মাটিতে ফাটল চলে ব্লাস্টিং
দিনে রাতে কাঁপে সব ঘাট পথ
আগুন মাটিতে গড়েছে বসতি
প্রাণ অনিশ্চিত কাঁপে জনপদ

এই জনপদ হাত ধারাধরি
গাঁজা মদ আর নারী জুয়াচুরি
মরদ কাজের বাহানা দিচ্ছে
জ্বলে রাখ হয় বাবাদের পরী

ডিনামাইটের কাঁপানো জীবন
দু’হাতে রয়েছে থোকা থোকা টাকা
মাটির উপরে বসতি উঠেছে
ভেতর ভেতর সবটাই ফাঁকা

সেই সব কিছু ফাঁকার জীবন
মরছে মানুষ কী যে হুটহাট
জ্বলন্ত প্রাণ জেনে গেছে তাই
জীবন মানেই আরও আহ্লাদ

আটখানা হয়ে মিথুনাবদ্ধ
আটখানা হয়ে ভাল খানা-পিনা
মদ ও গাঁজার প্রতি কণা জানে
আলোর সামনে জিন্দেগি জিনা


এইখানে এসে দেখি পাইপ ফেটেছে
জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে এদিক ওদিক
এইখানে এসে দেখি নাইট শিফটের লোক
তালরস খাচ্ছে জ্ঞান শূন্য দিগবিদিক
এ দূর দূরত্ব নয় জীবনের কাছাকাছি
শহরের স্তরে মেলাতে পারে না নিজেদের
নেশাখোর হয়ে বাড়ি ফিরে আসে
নেশাই জীবন অন্ন জল জল অন্ন এদের
এইসব লোক যাকে লোকে করে ক্ষমাঘেন্না ছি ছি
এরাই সহজে কত নীচে নেমে যায়
অনায়াসে বলে কয়লা কাটতে গেছি।
কয়লার দেওয়াল কয়লার চাল চারিদিক কালো
কে কোন ধসের খেসারত দিতে ভুল করে পা মেলালো,
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সোজা অন্ধকার ও গলিতে
এইসব নিয়ে হাসাহাসি হয় নাক তোলে শহরতলিতে
শহরতলির যতটুকু আলো এদের হাতের মায়াদাগ
প্রসারিত কাঁধে তুলে নেয় যারা জানবাজিরাখা ঘামের সোহাগ!


ভাস্কর সুতার

ভাস্কর সুতার

গামছা

গামছা নেবে গো গামছা, বসিরহাটের গামছা…

রোগা কালো ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন,

কাঁধে তার চকরাবকরা গামছা

গামছা নিয়ে যান, গামছা, শীত গরম বর্ষা সুতির গামছায় ভরসা।

টুনটুনির বাসার মতোই উল্টে গেল ভবিষ্যৎ

দারুণ আনন্দে মাত্রই মুখে দিয়েছি কাঁচামিঠে আমের শেষটা

গামছার করুণ স্বরে…

হৃদয়ের বেইজ্জতি আমাকে ঝাঁকিয়ে দিল খানিকটা

এই অমসৃণ শরীরে মাত্র ২০০ টাকা রোজ গন্ডা তার

গামছার শরীর থেকে দেখছি,আর,

ভাবছি,আমিও কি বৃদ্ধ হব?

নুন গলাবার ব্যথা জাগছে

ভাত জেগেছে জিভের দেওয়ালে।

গামছা নেবে গো গামছা সুতির গামছা

গামছা নেবে! গামছা

বিশেষ দিন

যদি দেখা না হয়, জানবে নিতান্তই তোমার কেউ ছিলাম না!

তাঁতির ছেলে খুব চালাক নই, তবে বোকা বললে বেমানান।

এরকম শীতে বাবাকে জড়িয়ে ধরলে উষ্ণতা বুঝেছি।

অবাক হলে বুঝি? আরে না, শোনো

আমারও হৃদয় আছে, মৃত্যু আছে।

আরে, বেশি ভাবুক হলে ভুলে যাবে

মনে রাখো। আমাদের আর দেখা হবে না

এমন বিশেষ দিন মনে রাখো।

ঢেউয়ের মতো 

প্রতিটা নদীর সঙ্গে হেঁটেছি

দেখেছি মানুষ বড় একা।

সেতু পেরিয়ে দেখেছি 

মানুষ ভীষণ অসহায়।

মানুষ মানুষে লুকিয়ে গেছে,

আর মন থেকে পুষ্পাঞ্জলি শপে গেছে

নদীর দিকে। অবাক পৃথিবীর দিকে 

তাকিয়ে দেখেছি মানুষ ভীষণ একা

নদীর মতো

ঢেউয়ের মতো

ভিতরে যে পুড়ছে

ভিতরে যে পুড়ছে,

অনেক দিন আলাপ নেই তার সঙ্গে।

মুখোমুখি দাঁড়াবার মতো জল এখনও পাইনি।

তবে হাঁটছি, ঝরে যাওয়া শালপাতার বাগান দিয়ে।

সামনে চন্দ্রবোড়া, ভিতরে আগুন

অনেক দিন আলাপ নেই তার সঙ্গে।

তবুও হাঁটছি মুখোমুখি দাঁড়াবার…

মাংস শরীরে বজ্রবিদ্যুৎ খেলে যায়

রক্তের গন্ধ ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি বরাবর 

বেশ বুঝছি, এ শরীর নেশাগ্রস্ত  

ভিতরে পুড়ছে ছাই পর্যন্ত

উত্তরের হাওয়ায় টের পাবে।

ধর্ম

অরুণ আলোয় দেখেছি তোমার বিরহ ধুলো ঝড়ে কতটুকু নীরব করেছে বন্ধুদের আড্ডায় আমাকে।

তোমার প্রেমে যে তামাক ছিল

যে ভিজা মাটি ছিল

যে কৃষক ছিল

যে নাঙল ছিল

তাদের বলে দিয়ো, তারা ভুল ছিল 

তাদের বুকের উপর দাঁড়িয়ে ভেঙে দিয়ো পাঁজর 

সমস্ত সফলতার শেষে, আমাকেই জন্ম দেবে,

ধর্মে!