You are currently viewing সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম, ১৪১ সংখ্যা

সাপ্তাহিক কবিতা আশ্রম, ১৪১ সংখ্যা

মলয় গোস্বামী

দীর্ঘ কবিতা

মলয় গোস্বামী

বেড়ানোর মতন উদাসীন

হঠাৎই বৃষ্টি নামল …
দূর দিগন্তের অনুভব এসে থমকে দাঁড়াল
তুমি অতি সন্তর্পণে ভাবলে, যদি কেউ আসে
যদি কেউ জলে শব্দ তুলে পৃথামঞ্জরীর কথা
বলতে আসে বাড়ি বয়ে !

এই ভেবে তুমি চলে গেলে পেছন-বারান্দায়
হঠাৎ কেউ ঘরের ভেতরের টেবিলে রাখল
চাবির তোড়া, আর
বেশ জোরে শব্দ হল—
তুমি কেঁপে উঠলে আর বললে
সেই ট্রামের কথা একবার বলো না
তখন বৃষ্টি নেমেছে সেতারের ঝালার মতন …

তুমি ভাবলে এইবার হয়ত ওই চাবিগুলি একে একে
খুলে ফেলবে তোমার ছোট-ছোট বাক্সগুলি
যা তুমি সারা গ্রীষ্ম শরৎ হেমন্ত বসন্ত
বন্ধ করে আগলে রেখেছ।

তখন পেছনের বারান্দায় সোজা দাঁড়ালে
টালির ছাদ থেকে অঝোর ঝরণ হচ্ছে
মিহি স্পন্দনের মতো বৃষ্টি
একদিন সে গ্রীষ্মে উড়ন্ত রেললাইনের ওপাশ থেকে
চলে গিয়েছিল
যাওয়ার আগে তুমি জিগ্যেস করেছিলে
কোথায় যাচ্ছ?
সে বলেছিল, মেঘ পেরিয়ে।
সেসময় তোমার মন ভেঙে পড়েছিল কাচের মূর্তির মতো !
বলেছিলে, ফিরবে কবে?
বলেছিল, বৃষ্টির দিন।

তারপর থেকে কত বৃষ্টির দিন গেল …
ছোটদের ইস্কুল বারবার ছুটি হতে থাকল …
শত শত হাত বানাতে থাকল কাগজের নৌকা
তোমার অতসী মামী রাগ করে চলে গিয়ে আবার
ফিরে এল ছোট্ট ঘরে
পাখি তার বাচ্চাকে খাইয়ে বড় করে আকাশে ওড়াল
তবু সে ফিরল না !

একদিন রাগ করে উঠোনের মাটি হাতে তুলে
কী যেন প্রতিজ্ঞা করতে গিয়ে বলে উঠলে, না থাক।
ময়ূরের প্রথম নাচের মতন দ্বিধা তোমার প্রতিজ্ঞায়

আবার বললে সেই ট্রামের কথা বলতে
আর দ্যাখো সেই বৃষ্টি নেমেছে—-
গাছের পাতায় বেজে উঠেছে বাজনা, যা তুমি বাজাওনি
মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে ছোটছোট ছেঁড়া কাগজ
সেই কাগজ যা তোমার কাছে এসেছিল চিঠি হয়ে—

দ্যাখো সেই বৃষ্টি
অনুরূপমধুরিমা …
ক্লান্ত সুন্দরের সেই বেড়ানোর মতন উদাসীন
সে আসবে
তুমি সামান্য নীচে নেমে দাঁড়াবে এবার
তারপর তুমি বলে উঠবে — রিমঝিম।

আবার ভাবলে সেই ট্রামের কথা …
সেও এক ব্যাপার
শুনেই মনে হল যদি আর
ফিরে না যাই —মনে হল আমার। রিমঝিম ।

মানুষের বেপথু চারণকে পাশে ঠেলে দেয় এই জল
চোখে পড়ে ভালবাসা
আকাশ একবার আলো দিল, সে তোমারই জন্যে ।
তীক্ষ্ণ সুতোর মতন তৈরি হল আলোর পথ
চার দিকে লক্ষলক্ষ সুচের মতন বৃষ্টিধারা আর
সে ওই হেঁটে আসছে মহা কোনও দিগন্ত থেকে
আলোর সরুপথ হয়ে উঠছে তোমার —

নীচে নেমে দাঁড়াও
আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে ভাবো
ধুয়ে যাচ্ছ তুমি
বৃষ্টির মতন ভালবাসা হয়ে যাচ্ছ তুমি।

Woman of the Rain by Svetlana Telets

যদি আর ফিরে না যাই— মনে হল আমার
যদি পথ যেতে যেতে ফিরে আসে আমার কাছে, যদি হাত ধোবার পরও ঘুরে ঘুরে বেড়াই ঘরের মধ্যে, তবে শুধু তোমার কথা মনে পড়ে।
এই মনে পড়া নিয়েই যত জ্বালা । সেই যে তুমি ট্রামে চেপে যাচ্ছিলে…. । আমি দৌড়াচ্ছিলাম। ট্রামের পাশে পাশে দৌড়াচ্ছিলাম। অত জোরে দৌড়াতে তো আমি পারি না। সে তো তুমি জানো। তুমি ট্রামের গেটে এসে হাত নেড়ে নেড়ে আমার বারণ করছিলে। কিন্তু মন কি কথা শোনে। আমার ফোঁসফোঁস শব্দ তখন ট্রামের সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে। তুমি হাত নাড়ছ। তোমার অতুলনীয় ফর্সা ডান হাতখানি। দেখি কি, মনুমেন্টের মাথা ছুঁয়ে দিয়ে যে রোদ্দুর নীচে নামছে, সে এসে তোমার হাতের ওপর পড়ল ! তুমি হাত নাড়ছ আর রোদ্দুরও নড়ছে ! যাহ্! এসব হয় নাকি! তুমি শুনলে এ কথাই বলতে। তবু আমি দেখলাম এরকম।
সেই ট্রামে তুমি ছিলে। আমি আজ ট্রামে উঠেছি। ট্রাম শব্দ করতে করতে চলছে … । আমি শুধু তাকিয়ে রয়েছি নগরের গরম হয়ে ওঠা রাস্তার দিকে। ভাবছি তুমিও আমার জন্যে দৌড়াবে। কিন্তু তোমাকে তো দেখতেই পাচ্ছি না।
বহুবছর পর আমি বিষণ্ণ, থুম হয়ে যাওয়া ট্রাম ডিপোয় এসেছি সেই তোমার চড়া ট্রামের খোঁজ নিতে। ভেঙে গেছে। ভেঙে গেছে ! সেই ট্রাম আর নেই। মনুমেন্টের মাথায় রয়েছে সূর্যের আলো। কত ভাঙা ট্রাম। রঙ উঠে গেছে তাদের। শুনতে পেলাম ট্রামদের ফোঁস ফোঁস শব্দের হাঁপানো । ভাঙা সিটে বসে পড়লাম। তোমার কথা ভাবলাম। ভাবলাম তোমার কমলা রঙের ঠোঁটের কথা। ভাবলাম —তোমার গলার কথা।
হঠাৎ শব্দ করে ভাঙা, লড়ঝড়ে ট্রাম চলতে আরম্ভ করল। চমকে উঠলাম। কে চালাচ্ছে? কে! কেউ নেই। শহরের রাস্তার দু’হাত ওপর দিয়ে ট্রাম চলছে … ট্রাম চলছে … আমি দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছি। বলছি, দৌড়িও না। দৌড়িও না। দৌড়িও না।